পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল কাকদ্বীপ। দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি প্রশাসনিক মহকুমা অঞ্চল এই কাকদ্বীপ।
ভৌগোলিক বিচারে কাকদ্বীপ ২১.৮৭০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.১৯০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। মুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত কাকদ্বীপ আসলে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের এক বিশেষ অংশ। এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের দক্ষিণাংশে রয়েছে হেনরি দ্বীপ, সাগরদ্বীপ, ফ্রেডরিক দ্বীপ এবং ফ্রেজারগঞ্জ দ্বীপ। কাকদ্বীপ মহকুমা সুন্দরবনের জনবসতির এক বিশেষ অংশ।
বেশ কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের বুকে অসংখ্য দ্বীপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এই কাকদ্বীপে একসময় নির্জন ও দুর্গম বনভূমিতে কাকেদের বিচরণ ছিল। প্রচুর কাকের উপস্থিতির কারণে এই দ্বীপের নাম কাকদ্বীপ হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। জনশ্রুতি আছে যে গঙ্গার ব-দ্বীপের এক বিশেষ বাঁকে সে সময় সাপে কাটা মানুষের মড়া বা শবদেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে এসে থামতো, সেই সঙ্গে মৃত পশুদের দেহও একইভাবে ভাসতে ভাসতে এসে ঐ বাঁকে আটকে যেত। মড়া ভাসানো হত বলে সেই গঙ্গার শাখাটির নাম হয়েছিল মুড়িগঙ্গা। আর মুড়িগঙ্গার ঐ বিশেষ অঞ্চলে মড়া আটকে থাকার কারণে সেখানে প্রচুর কাক এসে জড়ো হত। সে কারণেই হয়তো এই অঞ্চলের নাম হয় কাকদ্বীপ। মধ্যযুগের বিভিন্ন কাব্যে বণিকদের বাণিজ্যযাত্রার বর্ণনার প্রসঙ্গে কাকদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায়। মঙ্গলকাব্যের মধ্যেও দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি অঞ্চল হিসেবে কাকদ্বীপের নাম পাওয়া যায়। ১৬৭৬ থেকে ১৮৮৬ সালের মধ্যে লেখা কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ ও ‘কমলামঙ্গল’ কাব্যে এই কাকদ্বীপের পরিচয় পাওয়া যায়।
বহু প্রাচীনকাল থেকেই যে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মাটি খুঁড়লেই। কাকদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে বহু পাথরের মূর্তি, তাম্রশাসন, প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। গুপ্ত যুগ বা, পাল-সেন যুগেরও বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে এই জনপদে। কাকদ্বীপের অনতিদূরেই পৌরাণিক ঐতিহ্য সম্বলিত সাগরদ্বীপ। পদ্মপুরাণে বলা হয় এই সাগরদ্বীপেই ছিল এক সময় বিখ্যাত কপিল মুনির আশ্রম। তাছাড়া পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী এই সাগরদ্বীপ ছিল চন্দ্র বংশের রাজা সুষেণের রাজ্যসীমার অন্তর্গত। সাগরদ্বীপের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহাকবি কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যের বিখ্যাত কিছু শ্লোকের মাহাত্ম্য। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের প্রারম্ভেই দেখা যায় সাগরসঙ্গমে একটি নৌকা এসে অদূরে একটি তীরভূমি দেখতে পেয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে এসে থামে। নৌকার অন্য যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন নবকুমারও। হিন্দুদের কাছে আজও এই সাগরদ্বীপ এক আলাদা মাহাত্ম্য বহন করে। যুগ যুগ ধরে গঙ্গাসাগর মেলায় বহু মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। প্রথমে কুল্পি থানার অন্তর্গত ছিল সাগরদ্বীপ, পরে যদিও তা কাকদ্বীপের অন্তর্গত হয়। প্রাচীনকালে নিম্নবঙ্গে গঙ্গারিডি নামের এক বিশেষ জনপদ ছিল যার প্রধান কেন্দ্র মানা হত সাগরদ্বীপকে। এই গঙ্গারিডি অঞ্চলের শাসক ও মানুষেরা যেমন খুবই নৌ-চালনায় পারদর্শী ছিল, তেমনই তাদের হস্তীবাহিনীও ছিল বেশ শক্তিশালী। অনেকেই বলে থাকেন গঙ্গারিডির হস্তীবাহিনীর পরাক্রম দেখে স্বয়ং আলেকজাণ্ডার নাকি পলায়ন করেছিলেন। এই সাগরদ্বীপের নিকটস্থ কাকদ্বীপ ইতিহাসে আরেকটি কারণে বিখ্যাত আর তা হল তেভাগা আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে অন্যতম বৃহত্তর সংগঠিত কৃষক আন্দোলন ছিল এই তেভাগা আন্দোলন। ভাগচাষীদের স্বত্ব স্বীকার করার দাবিতে কলকাতার বিখ্যাত কৃষক নেতা সুনীল চ্যাটার্জি ১৯৪৬ সালের ১৮ নভেম্বর কাকদ্বীপের ডাকবাংলো ময়দানে এক বিরাট জনসভা আয়োজন করেন। লাঠির মাথায় লাল ঝাণ্ডা বেঁধে শত সহস্র কৃষক সেদিন স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিল এই জনসভায়। ভাগচাষীদের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন কংসারী হালদার, যতীন মাইতি, গুণধর মাইতি, রাজকৃষ্ণ মণ্ডল এবং মানিক হাজরা। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কাকদ্বীপের এই কৃষক আন্দোলনের দায়িত্বে থাকার অপরাধে মানিক হাজরার কারাবাসও হয়েছে। ১৯৪৬ সালেই কাকদ্বীপের শিবরামপুরে ভাগচাষীরা বহু কালের পুরনো প্রথা ভেঙে নিজে খামার তৈরি করে তাতে ধান তোলেন প্রথম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জোতদার লাঠিয়াল পাঠিয়ে সেই ভাগচাষীকে ধরে নিয়ে আসে কাছারিবাড়িতে। এই সংবাদ পেয়ে হাজার হাজার কৃষক একজোট হয়ে কাছারিবাড়িতে জমায়েত হয় এবং জোতদারের এই অন্যায়ের বিরোধিতা করে। ভাগচাষী মুক্তি পায়। তেভাগা আন্দোলন আরো শক্তিশালী হয়। কাকদ্বীপ এলাকায় তখন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন যতীন মাইতি। তিরিশের দশকে কাকদ্বীপে কৃষক অসন্তোষ দেখা দেয়। এখানকার অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষের উপর জমিদার ও জোতদারেরা নিরন্তর অত্যাচার চালাতো, খাজনা আদায় করতো জোর করে। এই অঞ্চলের পৌণ্ড্র সম্প্রদায়ের মানুষ কংসারী হালদার ১৯৪০ সালে এই কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। ১৯৪৮ সালের অক্টোবর মাসে কাকদ্বীপের চন্দনপিঁড়ি গ্রামের অহল্যা নাম্নী এক গৃহবধূ সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। একে কেন্দ্র করে সারা কাকদ্বীপ জুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ আর হরতাল। এই আন্দোনের একেবারে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেন কংসারী হালদার। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তিনি মধু ছদ্মনামে আত্মগোপন করে থাকেন। এই বিশেষ ঘটনার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় বিখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শপথ’ কবিতা এবং সাধন গুহের লেখা অন্যতম গণসঙ্গীত ‘শোন কাকদ্বীপ রে’ লেখায়। ‘শপথ’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন আমাদের মনে পড়ে যায় – ‘সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল’। সাধন গুহের লেখা গানে কৃষক-কন্যা অহল্যার করুণ গাথার ছবি ফুটে ওঠে –
“শোন কাকদ্বীপ রে
এই চন্দনপিঁড়ি শ্মশানে
অহল্যা মার চিতার আগুন জ্বলেরে।
আহা কিষাণী মার প্রসব যন্ত্রণা
বাতাসে বাতাসে গুমরিয়া কান্দেরে।। “
কাকদ্বীপের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মধ্যে কংসারী হালদার, যতীন মাইতি প্রমুখদের নামই সর্বাগ্রে স্মরণীয়।
শিক্ষাজগতে কাকদ্বীপের বিভিন্ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬৫ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্দরবন মহাবিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই কলেজে বাংলা, ইতিহাস, ইংরেজি, গণিত, সংস্কৃত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, শিক্ষাবিজ্ঞান, হিসাবশাস্ত্র, ভূগোল ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়। কাকদ্বীপ বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতন এখানকার একটি অন্যতম প্রধান বাংলা মাধ্যম স্কুল যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এর আগে ১৯৬৩ সালে স্থাপিত হয় কাকদ্বীপ শিশু শিক্ষায়তন উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া নারীশিক্ষার জন্য ১৯৮০ সালে কাকদ্বীপে স্থাপিত হয় কাকদ্বীপ গভর্নমেন্ট স্পনসরড আশ্রম হাই স্কুল ফর গার্লস। এছাড়া কাকদ্বীপের অন্যান্য স্কুলগুলির মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যামন্দির উচ্চ বিদ্যালয়, অক্ষয়নগর জ্ঞানময়ী বিদ্যানিকেতন, অক্ষয়নগর কুমারনারায়ণ মাধ্যমিক শিক্ষায়তন, ভুবননগর উচ্চ বিদ্যালয়, ভুবননগর ভুবনমোহন বিদ্যাপীঠ, কালিনগর দ্বারিকানাথ ইনস্টিটিউশন, কাশীনগর উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি। এদের মধ্যে সব স্কুলেই পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের সুবিধে আছে, একমাত্র ১৯৪২ সালে স্থাপিত ভুবননগর উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তও ক্লাস করানো হয়।
কাকদ্বীপের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে গাজন গান। চৈত্রমাসের শেষে চড়কের মেলায় গাজন গানের আসর বসে এখানে। শিব, পার্বতীর নানা পৌরাণিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে পালাগান রচিত হয়। তাছাড়া নদীর উজানের টানে কিংবা ভাটার টানে নৌকা বাওয়ার ক্লান্তি মুছে ফেলতে কাকদ্বীপের মাঝিভাইদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে গেছে ভাটিয়ালি গান, সারি আর জারি গান। এই জনপদের খানিক অংশ সুন্দরবনের অন্তর্গত হওয়ার সুবাদে সুন্দরবনের বাঘের প্রতীক দক্ষিণ রায়ের পূজাও প্রচলিত আছে কাকদ্বীপে। সুন্দরবনের সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ কেন্দ্রীভূত রয়েছে বনবিবি আর দক্ষিণ রায়কে ঘিরে, কাকদ্বীপও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এখানকার বেশিরভাগ মানুষই মৎস্যজীবি হওয়ার কারণে তাঁদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে বদর-পীরের কিংবদন্তী।
কাকদ্বীপে এক সাগর ছাড়া আর বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান নেই। কিন্তু কাকদ্বীপ মহকুমার অন্তর্গত সাগরদ্বীপ একটি বহুলচর্চিত গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতি বছর বহু মানুষ এখানে তীর্থ করতে আসেন। এছাড়া কাছেপিঠেই রয়েছে সজনেখালি পাখিরালয়, খটির বাজার, লর্ড ক্যানিং-এর বাড়ি ইত্যাদি। এখান থেকে সুন্দরবনও খুব দূর নয়। তাই কাকদ্বীপ ভ্রমণে এসে হাতে সময় নিয়ে সুন্দরবনটাও ভালো করে ঘুরে দেখা যায়। কপিলমুনির আশ্রম, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মন্দির ছাড়া কাকদ্বীপের খুব কাছেই রয়েছে বকখালি, রয়েছে ডায়মণ্ড হারবারের মোহনা।
সব মিলিয়ে কাকদ্বীপের কাক এখন আর খুঁটে খুঁটে মড়া খায় কিনা জানা নেই ঠিকই, কিন্তু গঙ্গা আর সমুদ্রের স্রোত কুড়ে কুড়ে পাড় খেয়ে চলেছে ক্রমশ। অদূর ভবিষ্যতে কাকদ্বীপের ভাঙনের জেরে কতটা স্থলভূমি আর অবশিষ্ট থাকবে বলা মুশকিল। তবু নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে কাকদ্বীপ ক্রমশ এগিয়ে চলেছে প্রগতির পথে।