
বীরভূম জেলাতে অবস্থান করছে মায়ের পাঁচটি সতীপীঠ। বক্রেশ্বরে দেবী মহিষমর্দিনী মন্দির , লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলা মন্দির, নলহাটীতে নলাটেশ্বরী মন্দির এবং সাঁইথিয়ায় দেবী নন্দিকেশ্বরী মন্দির। তারাপীঠকেও সতীপীঠ ধরা হলে সংখ্যাটা ছয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে সতীর গলার হাড় পড়েছিল। মতান্তরে এখানে সতীর কণ্ঠহার পড়েছিল। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে সাধক বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে পূজা দিয়েই সিদ্ধিলাভ করেন। বলা হয় যখন মায়ের দেখা পাওয়ার জন্য তিনি তারাপীঠে সাধনা করছিলেন, তখন মা তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। বামাক্ষ্যাপাকে মা নন্দীকেশ্বরী স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেছিলেন আগে তাঁর পুজো করতে, তারপরেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব হবে।
নন্দিকেশ্বরী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মন্দির থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ময়ূরাক্ষী নদী আর ১ কিলোমিটারের মধ্যে সাঁইথিয়া জাংশন স্টেশন। সাঁইথিয়া জায়গাটি আগে নন্দিপুর নামে পরিচিত ছিল। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে দেবী নন্দিকেশ্বরীর নামেই এই শহরের নাম হয়েছিল নন্দিপুর।
বলা হয় এখানে আগে জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এবং পাশে ছিল মহাশ্মশান। তার পাশ দিয়ে বয়ে যেত ময়ূরাক্ষী নদী। বনের মধ্যে বটগাছের নীচেই মায়ের অবস্থান ছিল। যদিও তখনও এই স্থান নন্দিকেশ্বরী সতীপীঠ রূপে পরিচিতি পায় নি। স্বয়ং মা নন্দিকেশ্বরী দাতারাম ঘোষ নামে এক ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে মায়ের মন্দির নির্মাণ ও মায়ের পুজো প্রচারের আদেশ দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই নন্দিকেশ্বরী মন্দির সতীপীঠ বলে পূজা পেতে শুরু করে। দাতারাম ঘোষ ছিলেন সাঁইথিয়ার জমিদার পঞ্চানন ঘোষের পূর্বপুরুষ। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন দক্ষিনেশ্বরের বাসিন্দা। সাহেবদের কাছে কাজ করার সূত্রেই তার সাঁইথিয়ায় যাতায়াত। যাবার পথে ক্লান্ত হয়ে বটবৃক্ষের নীচে ঘুমিয়ে পড়লে তিনি মায়ের স্বপ্ন পান। এবং মা নন্দিকেশ্বরী তার মন্দির নির্মাণের আদেশ করেন। সেই অনুযায়ী তিনি মায়ের মন্দির নির্মাণ করান। এই পীঠকে তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে মূল পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে। সেই মতে বলা হয় এখানে সতীর গলার হাড় পড়েছিল। কিণ্তু শিবচরিত গ্রন্থে এটিকে উপপীঠ বলা হয়েছে। সেই মতে বলা হয় এখানে সতীর কণ্ঠহার পড়েছিল। কোনো গ্রন্থে এই পীঠকে ঊনপঞ্চাশতম পীঠ আবার কোথাও পঞ্চাশতম পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে।

আশির দশকে সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা সতীপীঠ নন্দিকেশ্বরীর অনেক সংস্কার করে বর্তমান মন্দির গড়ে তুলেছেন। এক বিশাল বটবৃক্ষ ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে মন্দিরের আঙিনা। দেবী নন্দিকেশ্বরীর মূর্তি বলতে একটি পাথর। পাথরের গায়ে রয়েছে দেবীর তিনটি চোখ ও মাথায় মুকুট পড়ানো। মুকুটটি রূপালী এবং তিনটি চোখ সোনালী। যদিও মায়ের মূর্তিটি কালো পাথরের, কিন্তু বর্তমানে এর রঙ প্রায় লাল। কারণ ভক্তরা প্রার্থনার জন্য পাথরের গায়ে সিঁদুর দিয়ে থাকেন। প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সেই অনুযায়ী এই মন্দিরে দেবীর নাম নন্দিনী বা নন্দিকেশ্বরী ও ভৈরবের নাম নন্দিকেশ্বর। নন্দিকেশ্বরী অর্থাৎ নন্দীর আরাধ্যা দেবী।
নন্দিকেশ্বরী মন্দির যাবার সবচেয়ে ভালো উপায় ট্রেনে করে সাঁইথিয়া স্টেশন। হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে সাঁইথিয়া স্টেশন অবধি সরাসরি ট্রেন আছে। ২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির পর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কয়েকটি ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল। এছাড়াও অনেক ট্রেন আছে।
ট্রেন নাম্বার | ট্রেনের নাম | কোথা থেকে ছাড়বে | কখন ছাড়বে | সাঁইথিয়া জাংশন কখন পৌঁছবে | কোন দিন চলে |
---|---|---|---|---|---|
০৩০১৭ | গণদেবতা কোভিড - ১৯ স্পেশাল | হাওড়া | সকাল ৬টা ৫ মিনিট | সকাল ৯টা ২১ মিনিট | সবদিন |
০৩১৭৫ | শিয়ালদহ - শিলচর কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেস্টিভ স্পেশাল | শিয়ালদহ | সকাল ৬টা ৩৫ মিনিট | সকাল ৯টা ৪৬ মিনিট | সোম, বুধ, শনি |
০৩১৭৩ | শিয়ালদহ - আগরতলা কাঞ্চনজঙ্ঘা ফেস্টিভ স্পেশাল | শিয়ালদহ | সকাল ৬টা ৩৫ মিনিট | সকাল ৯টা ৪৬ মিনিট | রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র |
০২৩৪৭ | শহীদ (ইন্টারসিটি) স্পেশাল | হাওড়া | বেলা ১১টা ৫৫ মিনিট | দুপুর ২টো ৪৪ মিনিট | সবদিন |
স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে থাকার ব্যাপার নেই। তবে দূর থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য মন্দিরের মধ্যে আছে বালানন্দ যাত্রীনিবাস। স্টেশনের কাছেও অনেক ঘর পাওয়া যায়। স্টেশন থেকে মন্দির পায়ে হাঁটা পথ। তবে ঘর বুকিং এর আগে ভালো করে খোঁজ নেওয়া ভালো। বেশ কিছু হোটেল বা ঘর খুব একটা পরিষ্কার না।
মন্দিরে পূজা দিতে পারেন। পূজার প্রসাদ হিসাবে কলাবাতাসা খুবই পরিচিত। দেবীর মন্দির এবং ভৈরবের মন্দির ছাড়াও আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে এখানে। মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম। এই সমস্ত মন্দিরে ঘুরতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগবে। মন্দিরচত্বরে বিশাল বড় গাছটিতে ভক্তেরা তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য লাল এবং হলুদ সুতা বাঁধেন।
সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। মন্দির সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। রথযাত্রা ও বিপদতারিণী পুজোর সময়ে এই মন্দিরে ১০ থেকে ১৫ হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। দুর্গাপুজো, কালীপুজোতেও মায়ের বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়।
ট্রিপ টিপস
- কিভাবে যাবেন – নন্দিকেশ্বরী মন্দির আসার সবচেয়ে ভালো উপায় ট্রেনে করে সাঁইথিয়া স্টেশন। হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে সাঁইথিয়া স্টেশন অবধি সরাসরি ট্রেন আছে। স্টেশন থেকে মন্দির পায়ে হাঁটা পথ।
- কোথায় থাকবেন – স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে থাকার ব্যাপার নেই। তবে দূর থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য মন্দিরের মধ্যে আছে বালানন্দ যাত্রীনিবাস। স্টেশনের কাছেও অনেক ঘর পাওয়া যায়।
- কি দেখবেন – নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে পারেন। এছাড়াও আরও অনেক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে এখানে। মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম।
- কখন যাবেন – সারা বছরই এখানে আসা যায়।
- সতর্কতা –
- ঘর বুকিং এর আগে ভালো করে খোঁজ নেওয়া ভালো। বেশ কিছু হোটেল বা ঘর খুব একটা পরিষ্কার না।
- রথযাত্রা ও বিপদতারিণী পুজোর সময়ে এই মন্দিরে ১০ থেকে ১৫ হাজার ভক্তের সমাগম হয়ে থাকে। সেই সময় গেলে ট্রেন বা ঘর আগে থেকে বুক করে রাখতে হবে।
তথ্যসূত্র
- সত্যের সন্ধানে ৫১ পীঠ - হিমাংশু চট্টোপাধায়, সাঁইথিয়ায় মা নন্দিকেশ্বরী, পাতা নং ৯৪-৯৭
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.wbtourismgov.in/
- https://indiarailinfo.com/