রঘুনাথ মুর্মু

রঘুনাথ মুর্মু

পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু একজন ভারতীয় সাঁওতাল লেখক ও শিক্ষাবিদ যিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন সাঁওতাল ভাষার লিখিত বর্ণমালা অলচিকি আবিষ্কারের জন্য।  তিনি কেবল অলচিকি বর্ণমালার স্রষ্টাই ছিলেন না তিনি একাধারে কবি ও সাহিত্যিকও ছিলেন। 

১৯০৫ সালের ৫ মে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার ডাহারডি (দণ্ডবস) গ্রামে রঘুনাথ মুর্মুর  (Raghunath Murmu) জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মুর্মু  এবং মায়ের নাম সলমা মুর্মু । বাবা মায়ের চার সন্তানের মধ্যে রঘুনাথ হলেন তৃতীয় সন্তান।  সামাজিক রীতি মেনেই রঘুনাথের বাবা তাঁর তৃতীয় সন্তানের নাম রাখেন ঠাকুরদার নামে ‘চুনু’। ছোট থেকেই নানান রোগে ভুগতেন রঘুনাথ। পরবর্তীতে এক ওঝার পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ‘চুনু’ নামটি পাল্টে তাঁর তৃতীয় সন্তানের নাম রাখেন রঘুনাথ। রঘুনাথের  স্ত্রীয়ের নাম নুহা বাস্কে। 

রঘুনাথের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সাত বছর বয়সে গাম্ভারিয়া ইউ. পি. স্কুলে।  স্কুলে ওড়িয়া ভাষায় পড়ানো হত যা রঘুনাথের বোধগম্য হত না। এরপর বহড়দা এম. ই. স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। ১৯২২ সালে রঘুনাথ  এম. ই. পাশ করে বারিপদা হাইস্কুল অফ্ ময়ূরভঞ্জে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। ১৯৩১ সালে রঘুনাথ বারিপদা পাওয়ার হাউস থেকে শিক্ষানবিশীর কোর্স  করেন। এরপর রঘুনাথ, শ্রীরামপুর, গোসাবা এবং কোলকাতা থেকে বাণিজ্যিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন।  রঘুনাথ মুর্মুর কর্মজীবন শুরু হয় লোকগণনার অস্থায়ী কর্মী হিসাবে। এরপর তিনি বারিপদার পূর্ণ-চন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল  ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষক হিসাবে কিছুকাল কাজও করেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

স্কুলে পড়াকালীন ছুটিতে মাঝে মাঝেই দণ্ডবস গ্রামে চলে আসতেন রঘুনাথ।  এখানকার কাপি – বুরু নামক এক নির্জন জঙ্গলে খাতা পেন নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন।  এটা মনে করা হয়ে থাকে এই কাপি বুরু জঙ্গলেই তিনি অলচিকি লিপি আবিষ্কার করেন। ১৯২৫ সালে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ বর্ণমালা আবিষ্কার করেন।  ১৯৩৮ সালে অলচিকি লিপিতে লেখা ছাপার জন্য রঘুনাথ কাঠের মুদ্রণ যন্ত্র তৈরি করেন এবং ১৯৩৯ সালের বারিপদার এক সভায় রঘুনাথ অলচিকি লিপি এবং মুদ্রণ যন্ত্রকে জনসমক্ষে আনেন। এরপর তিনি কলকাতার স্বদেশি টাইপ ফাউন্ড্রিতে প্রথম ‘অলচিকি’-র টাইপ সেটিং তৈরি করান।  ১৯৪২ সালে দেশ জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান এবং একই সাথে অলচিকি ভাষার প্রচার করতে থাকেন।  ঝাড়খন্ড আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন তিনি। এই আন্দোলন ব্যাপক আকার নিলে আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে তাঁর নামে পুলিশ অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করে।  ফলত রঘুনাথ জামশেদপুর পালিয়ে যান এবং টাটা স্টিলে কাজ করতে থাকেন। 

সাঁওতাল জাতির শিক্ষা বিস্তারে অলচিকি লিপির প্রসারে আজীবন কাজ করে গিয়েছেন পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু। তিনি কেবল অলচিকি লিপি সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেননি।  তিনি একই সাথে শিশু সাহিত্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচনা করেছেন অলচিকি লিপিতে। ‘অল চেমেদ’, ‘অল উপরুম’ তাঁর দুটি শিশু পাঠ্য বই। ‘দাড়েগে ধন’ তাঁর রচিত একটি অনন্য নাটক। ‘পারশি ইতুন’ তাঁর রচিত অলচিকি লিপিতে ইংরেজি শিক্ষার বই। এছাড়া সাঁওতালি শিক্ষার জন্য তিনি ‘রণড়’ নামে সাঁওতালি ব্যাকরণ বই লিখেছেন। এছাড়া উপদেশ মূলক গানের বই ‘লাকচার’ এবং তিনখণ্ডে মহাকাব্যধর্মী গ্রন্থ  ‘হিতাল’ তাঁর সাহিত্য প্রতিভার অন্যতম পরিচায়ক। 

১৯৮২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রঘুনাথ মুর্মুর মৃত্যু হয়।  সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জন্মদিনটিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করেন। 

আপনার মতামত জানান