তরু দত্ত

তরু দত্ত

তরু দত্ত ( Toru Dutt) একজন ক্ষনজন্মা বাঙালি মহিলা কবি যিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় সাহিত্য রচনা এবং অনুবাদের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি শুধু কবি ছিলেন না, তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক ও অনুবাদকও ছিলেন।

১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ কলকাতার রামবাগানের (বর্তমানে মানিকতলার রমেশ দত্ত স্ট্রিট) প্রগতিশীল দত্ত পরিবারে তরু দত্তর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম গোবিন্দচন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম ক্ষেত্রমোহিনী দত্ত। দাদু রসময় দত্ত ও বাবা গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী, এর বাইরেও তরু দত্তের বাবা ছিলেন একজন সাহিত্য অনুরাগী ও একজন কবি। মা ক্ষেত্রমোহিনী দেবীও ছিলেন একজন অনুবাদক। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর সমান দক্ষতা ছিল। তিনি ‘দা ব্লাড অফ ক্রাইস্ট’ (The Blood of Christ) ইংরেজি বইটির বাংলা অনুবাদ করেন। তরুর দিদি অরু দত্তও ছিলেন অনুবাদক। বিখ্যাত ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক ও আই. এ. এস রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তরু দত্তর খুড়তুতো দাদা। তরু দত্তের লেখিকা হওয়ার বীজ তাঁর পরিবারের মধ্যেই নিহিত ছিল। বাংলা সাহিত্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের মত তরু দত্তও ছিলেন ক্ষনজন্মা। তবে গোবিন্দচন্দ্র দত্তের পরিবারে শুধু তরু নয় তাঁর বড়ো ছেলে আব্জু দত্ত ও বড় মেয়ে অরু দত্তও ছিলেন ক্ষণিকের অতিথি। অব্জু মারা যান মাত্র ১৪ বছর বয়সে, এবং অরু মাত্র ২০ বছর বয়সে।

তরু দত্তের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতায় তাঁর বাবা ও গৃহ শিক্ষক বাবু শিব চন্দ্র ব্যানার্জীর কাছে। তিনি তাঁর কাছে বাংলা সংস্কৃত ছাড়াও ফরাসি ও ইংরাজি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৬২ সালে তরুর পরিবার খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে। ১৮৬৯ সালে তরু পরিবারের সাথে ইউরোপ চলে যান। তরু দত্ত ও অরু দত্তই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা যাঁরা ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন। তাঁরা চার বছর ইউরোপে ছিলেন যার মধ্যে এক বছর ফ্রান্স ও তিন বছর ইংল্যান্ডে। এছাড়াও কিছু সময় তাঁরা ইতালি ও জার্মানিতেও থেকেছেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। এরপর তিনি সেখানকার ‘হায়ার লেকচার অফ উইমেন্স’ এ (Higher Lectures for Women” ) যোগ দেন। ১৮৭৩ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবার কাছে সংস্কৃত ও মায়ের কাছে প্রাচীন ভারত সম্পর্কে পাঠ গ্রহন শুরু করেন।

তরু দত্ত বেঁচে ছিলেন মাত্র ২১ বছর। জীবনের এই অল্প সময় তিনি রেখে গেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। ১৮ বছর বয়সে ফরাসি কবির লেকন্টে দে লিয়েল (Leconte de Lisle) এর কবিতা এবং জোসেফিন সোলারির (Joséphin Soulary) প্রবন্ধগুলির অনুবাদ করেন তিনি। ১৮৭৪- ১৮৭৭ সালের মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে দ্য বেঙ্গল ম্যাগাজিন ও দ্য ক্যালকাটা রিভিউতে সংস্কৃত থেকে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতেন। ভিক্টর হুগো ও এম. অ্যাডলফ থিয়ার্স-এর রাজনৈতিক বক্তৃতাও তিনি অনুবাদ করেন। তিনি প্রায় সত্তর থেকে আশি জন ফরাসি কবির মোট ১৬৫টি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘এ শিফ গ্লিন্ড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ড ‘ (A Sheaf Gleaned in French Field) নামে কবিতা সংকলন ১৮৭৬ সালে ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ থেকে প্রকাশ করেন। এই ১৬৫টি অনুবাদ সংকলনে আটটি কবিতা ছিল দিদি অরু দত্তের অনুবাদ করা। তরুর মৃত্যুর পর তাঁর বাবার চেষ্টায় এই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ ভারত থেকে ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তরু ও তাঁর দিদির লেখা আরও ৪৪টি নতুন কবিতা যোগ করা হয়, এবং ১৮৮০ সালে তৃতীয় সংস্করণ মেসার্স কেগান পল (Messrs Kegan Pau)l লন্ডন থেকে প্রকাশ করা হয়। তাঁর জীবনের একটা বড় সময় বিদেশে কাটলেও দেশ তাঁর বিস্মৃত ছিল না। দেশের গাছপালা-প্রকৃতি, সাহিত্য-মহাকাব্য সবকিছুই তাঁকে টানত, আর এরই প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর সৃষ্টিতে।

প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসির কোমলতা আর ইংরেজির আভিজাত্য এই তিন নিয়ে তরু দত্ত। অনেকে তাঁকে বাংলার কিটস্ বলেন। তাঁর লেখায় মানব জীবন সমস্যা যেমন উঠে এসেছে তেমনি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ছুঁয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঠিক মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। অনেক পৌরাণিক চরিত্রকে তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন যার মধ্যে ‘সাবিত্রীর উপাখ্যান’, ‘ধ্রুবোপাখ্যান’, ‘রাজর্ষি’, ‘লক্ষ্মণ’, ‘সীতা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রিচার্ড গার্নেড সম্পাদিত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক’-এ তাঁর কয়েকটি কবিতা সংকলিত হয়। ইংরেজি ও ফরাসি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে তিনি বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে ধীরে ধীরে খ্যাত হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তিনি ঠিক করেন দিদি অরুর সাথে একটাি ফরাসি উপন্যাস লিখবেন এবং দিদি সেই উপন্যাসের ছবি আঁকবেন। কিন্তু ১৮৭৪ সালে দিদির অকাল প্রয়াণ তাঁকে গভীর ভাবে আঘাত করে। দিদির দুঃখ ভুলে থাকার জন্য তিনি আরো বেশি পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকেন আর লিখতে শুরু করেন। ছোট মেয়ের মৃত্যুর পর শোকাহত গোবিন্দচন্দ্র তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন এবং সেগুলি প্রকাশে উদ্যোগী হন। এক স্প্যানিশ মেয়ের কাহিনী অবলম্বনে লেখা বিখ্যাত উপন্যাস( অসম্পূর্ণ) ‘বিয়াঙ্কা’ (Bianca) বা ‘ইয়ং স্প্যানিশ মেডেন’ (Young Spanish Maiden) ১৮৭৮ সালে দ্য বেঙ্গল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। মনে করা হয় ভারতীয় মহিলা দ্বারা রচিত এটাই প্রথম ইংরেজি ভাষায় লেখা উপন্যাস। এরপর ১৮৭৯ সালে প্রকাশ সাল হিসেবে দ্বিতীয় হলেও এটি তাঁর ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম বিখ্যাত উপন্যাস ‘লে জার্নাল ডি ম্যাডেমাইলেস ডি’আরভারস’ (Le Journal de Mademoiselle d’Aervers) প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় যা ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম কোন ভারতীয়ের উপন্যাস। পরে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এই উপন্যাস বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশ হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে ১৯৫৬ সালে এটিকে আবার বই হিসেবে প্রকাশ করা হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। এরপর ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনসিইয়েন্ট ব্যালাডস্ অ্যান্ড লেজেন্ডস্ অফ হিন্দুস্থান’ (Ancient Ballads and Legends of Hindutan) যা ভারতে ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। সমালোচক এডমন্ড গোস (Edmund Gosse) এই বইটি পড়ে ভূয়সী প্রশংশা করেন। ইউরোপে থাকার সময় সিডনি সাসেক্স কলেজের রেভারেন্ড জন মার্টিনের কন্যা মেরি মার্টিন এর সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিদেশে থাকার সময় দেশের আত্মীয়দের লেখা চিঠি এবং দেশে ফিরে আসার পর বন্ধু মেরি মার্টিনকে লেখা চিঠিগুলি ১৯২১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিহর দাসের দ্বারা ‘লাইফ অ্যান্ড লেটারস্ অফ তরু দত্ত’ (Life and Latters of Taru Dutt) নামে প্রকাশিত হয়। এই চিঠিগুলি থেকে তৎকালীন জীবনযাত্রা, তাঁর ভাবনা, প্রকৃতি প্রেম, মানব চেতনা সম্মন্ধে জানা যায়। এছাড়া এইসব চিঠিগুলো সাহিত্যিক গুণের দিক থেকেও সম্পদ হয়ে আছে। ইংরেজি ফরাসি ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করলেও তিনি জার্মান ভাষাও জানতেন।

১৮৭৭ সালে ৩০ আগস্ট যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র একুশ বছর বয়সে কলকাতায় তরু দত্তের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, শ্রী সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সাহিত্য সংসদ (১৯৬০) পৃষ্ঠা- ১৮৫
  2. Gosse Edmund (1913), critical kit-kats, London Willam Heinemann pp. 197-212
  3. https://en.wikipedia.org/
  4. https://www.prohor.in/
  5. https://blogs.eisamay.indiatimes.com/

3 comments

আপনার মতামত জানান