ক্যালেণ্ডারে দিন গুণতে গুণতে টুপ করে মহালয়া চলে আসে। পিতৃ তর্পণের ভিড় আর চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র মধ্য দিয়ে পুজোর সাজো সাজো রব আরো তুঙ্গে ওঠে। আর এক সপ্তাহ পরেই তো মা এসে যাবেন ঘরে, কৈলাস থেকে এই মর্ত্যধামে তার শুভ আগমন। মহালয়া বাঙালিদের কাছে তাই প্রতিবারই এক অন্যমাত্রা নিয়ে হাজির হয়। আর এই মহালয়ার আগে আগেই, কখনো আবার ঠিক আগেরদিনই আসেন বিশ্বকর্মা। বছরে সমস্ত পূজা-পার্বণের তারিখ, তিথি ইত্যাদি কখনোই এক থাকে না, পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই একটি পূজার তারিখ কখনোই প্রায় বদলায় না। জাতীয় ছুটির দিন যেন(প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পূজা একই তারিখে হয় কেন জানতে পড়ুন এখানে)! আর এই দিনেই প্রতিবার নিয়ম করে বাঙালিদের মধ্যে রান্নাপুজোর চল লক্ষ করা যায়। বিশ্বকর্মা পুজো ও রান্নাপুজো এদের সম্পর্কটা আসলে ঠিক কী? কেনই বা বিশ্বকর্মা পুজো ও রান্নাপুজো একসাথে আসে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
দেবতাদের মধ্যে শিল্পী বা স্থপতি বলা হয় বিশ্বকর্মাকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে বিশ্বের সকল প্রকার কর্মের তিনি অধিপতি, তাই তাঁর নাম বিশ্বকর্মা। শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা পুরাণের বিভিন্ন কাহিনিতে কখনো কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা শহর নির্মাণ করেন, কখনো রামায়ণে বর্ণিত রাবণ রাজার সোনার লঙ্কা তৈরি করেন, আবার কখনো বিভিন্ন দেবতাদের অস্ত্রগুলিও নির্মাণ করে দেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের জন্য ত্রিশূল, ব্রহ্মার পুষ্পক রথ, ইন্দ্রের বজ্র সবই দেব বিশ্বকর্মার তৈরি। হস্তীবাহনে আসীন বিশ্বকর্মা বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে, কামার-কুমোর-স্বর্ণলার-ঢালাইকর-শ্রমিকদের মধ্যে মহাসমারোহে পূজিত হন। প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মার পুজো হয়ে থাকে। আর দিনেই হয় রান্নাপুজো । এখন প্রথমেই প্রশ্ন আসতে পারে এই রান্নাপুজো ব্যাপারটা ঠিক কী? জানলে অবাক হবেন অনেকেই, এই রান্নাপুজো আসলে মনসাপুজোর সময়ে পালিত এক বিশেষ ব্রত। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় নাগপঞ্চমী তিথিতে বাঙালি মহিলারা পালন করেন এই রান্নাপুজো যার মূল নাম আসলে ‘অরন্ধন’। অরন্ধন অর্থাৎ রান্না না করা, কিন্তু পুজোর নামে এই রান্না না করার বদলে ঢালাও রান্নার ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়। এই রান্নাপুজোকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক বাঙালি পরিবারে অঢেল রান্নার চল রয়েছে। কিন্তু সেই রান্না করা হয় এই পুজোর আগের দিন, পুজোর দিন যেহেতু রান্না হয় না তাই ব্রতের নামটি যথার্থ বলেই প্রতিপন্ন হয় – অরন্ধন। এককথায় বলতে গেলে ভাদ্র মাসে রান্না করে আশ্বিনে তা খাওয়া হয় এই অরন্ধনের সময়। অবাক হলেন? না না অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরোটাই তো সময়ের হিসেব। বিশ্বকর্মাপুজো হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে। আর এই দিনেই হয় রান্নাপুজো বা অরন্ধন যা কিনা মনসাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভাদ্রের আগে বাংলায় শ্রাবণ মাস চলে – এই মাস শিবের মাস, এই মাস মনসার মাস। পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে বর্ষা-প্লাবিত বাংলায় প্রাচীন কাল থেকেই সাপের প্রকোপ দেখা দেয় আর সেই সাপের দংশন থেকে রক্ষা পেতে সহায় হন দেবী মনসা। তাই বর্ষার শেষে ভাদ্র সংক্রান্তিতে তাঁরই উদ্দেশে করা হয় মনসাপুজো ।
তাহলে দেখা গেল, ভাদ্র সংক্রান্তির এই একটি মাত্র দিনেই একইসঙ্গে অরন্ধন, মনসাপুজো এবং বিশ্বকর্মা পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাঙালি মহিলারা এই মনসা পুজোর দিনেই প্রচুর রান্না করেন, বহুরকম পদ রান্না করে রেখে দেন তারা পরেরদিনের জন্য। তাই পরেরদিন আর রান্না করা হয় না। মজাটা হল, মনসাপুজো এবং একইসঙ্গে বিশ্বকর্মাপুজোর দিন রান্না করা হয় যখন সেটা ভাদ্র মাসের শেষ দিন, বলা ভালো ভাদ্র সংক্রান্তি আর সেই রান্না খাওয়া হয় পরের দিন অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম দিনে। তাই আগে বলা হয়েছে, ভাদ্রে রান্না করে আশ্বিনে খাওয়ার রীতি রয়েছে এই অরন্ধন উৎসবে।
হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বকর্মা একাধারে কৃষিরও দেবতা আর সেই বিচারে রান্নাপুজো এক অর্থে বাংলার শস্যের উৎসব। নবান্নের মতো এই রান্নাপুজোও যেন দ্বিতীয় এক শস্যের উৎসব। বৃহৎসংহিতা অনুসারে বিশ্বকর্মা গ্রীষ্মকালের শেষে মেঘ তৈরি করে বর্ষণের মাধ্যমে কৃষিকাজ রক্ষা করে থাকেন। ফলন্ত শস্যের প্রতিভূ হিসেবে প্রচুর পদ রান্না করা হয় রান্নাপুজোকে কেন্দ্র করে। বিশ্বকর্মা পুজোর আগেরদিন অমাবস্যার সারা রাত ধরে কুটনো কাটা, রান্না চলে। ইলিশ মাছ, পোনা মাছ, কচু শাক, শাপলা, পুঁই শাক, চিংড়ি, আলুভাজা, কুমড়োর ঘন্ট, পায়েস ইত্যাদি আরো সমস্ত রান্না করা খাবার নিবেদিত হয় দেবী মনসার উদ্দেশ্যে। সারা রাত জেগে রান্না করে ভোরের সূচনায় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে শেষ হয় রান্না। যদিও রান্নাপুজোয় বসার আগে প্রাচীন বাংলার রীতি অনুযায়ী উনুনের চারপাশে চালগুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হতো। বিশ্বাস করা হয় দেবী মনসা বিবাহিত হওয়ায় তাঁকে দেওয়া হবে আমিষজাতীয় খাবার। অরন্ধনের দিন করা হয় ‘পান্না’ অনুষ্ঠান যেখানে পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে ডেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। বিশ্বকর্মা পূজা আর একইদিনে এই অরন্ধন পালনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে রাখিবন্ধন উৎসব পালনের দিনও কিন্তু সমগ্র বাংলা জুড়ে পালিত হয়েছিল ‘অরন্ধন’। যদিও সেই অরন্ধন ছিল সম্পূর্ণই আপামর বাঙালির এক রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা, লৌকিক পূজার অঙ্গ ছিল না সেটি।