মোহাম্মদউল্লাহ

মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ

বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্থান-পতনময় ইতিহাসে যাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ (Mohammad Mohammadullah) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ইতিহাসের ছাত্র হলেও পরবর্তীকালে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে যোগদান করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ। পরবর্তীকালে নিজেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ। এছাড়াও বিভিন্ন প্রশাসনিক পদের দায়িত্ব তিনি সামলেছিলেন দক্ষ হাতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন তিনি এবং রহমান সরকারের মন্ত্রীসভাতেও উজ্জ্বল স্থান ছিল তাঁর। সংসদের সদস্য হিসেবে যেমন নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ, তেমনি গণপরিষদের ডেপুটি স্পিকারের মতো সম্মানীয় পদেও বহাল ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ভুটান রাজ্যের সম্মানীয় পদক লাভ করেছিলেন তিনি। 

১৯২১ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার অন্তর্গত বামনী ইউনিয়নের সাইচা গ্রামে মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মুন্সি আবদুল ওয়াহাব (Munshi Abdul Wahab) ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। মোহাম্মদউল্লাহের মায়ের নাম জরিনা খাতুন (zarina Khatun)। জরিনার ছয় ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে অর্থাৎ মোট এগারোটি সন্তানের মধ্যে মোহম্মদউল্লাহ ছিলেন দশম সন্তান। 

মোহাম্মদউল্লাহের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়েছিল স্থানীয় রাখালিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে। তারপর তিনি ভর্তি হয়েছিলেন লক্ষ্মীপুর মডেল হাই স্কুলে। ১৯৩৮ সালে সেই হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি ১৯৪০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে। আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য এবং ইতিহাসে প্রবল আগ্রহের কারণে ইতিহাসে অনার্স সহ তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বছর সেখানে মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করে ১৯৪৩ সালে অনার্স সহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে সক্ষম হন মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ। কিন্তু কেবল ইতিহাসে ডিগ্রি অর্জন করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি। মেধাবী মোহাম্মদ আইন সম্পর্কে উৎসুক হয়ে ওঠেন এবং আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য চলে আসেন কলকাতা শহরে। কলকাতায় অবস্থিত ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন আইন অধ্যয়নের প্রতিষ্ঠান রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ নামে পরিচিত) এবং পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আইন অধ্যয়ন করে ডিগ্রি লাভ করেন তিনি ১৯৪৮ সালে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আইনের পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আইনজীবী হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে ঢাকা জেলা কোর্টে আইনচর্চা শুরু করেন মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ। পরবর্তীকালে তাঁর পসার বৃদ্ধি পেলে এবং আইনজীবী হিসেবে দক্ষ হয়ে ওঠার পর ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন তিনি এবং সেখানেই আইনচর্চা চালাতে থাকেন। 

ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বে। এই দলের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও। পরবর্তীকালে তাঁর কৃতি কন্যা শেখ হাসিনা এই দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে এই আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদানের মাধ্যমে মোহাম্মদউল্লাহ সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিজের রাজনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করে তিনি উচ্চ নেতৃত্বদের প্রশংসা লাভ করেন এবং ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলা আওয়ামী মুসলিম লীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদের দায়িত্ব সামলেছিলেন দক্ষ হাতে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের অবসান ঘটানোর জন্য যে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে কারারুদ্ধও করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালে লক্ষ্মীপুর-২ রায়পুর থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেনে নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ অর্জন করেন। 

এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উজ্জ্বল এক অধ্যায়। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। এই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবর রহমানের গ্রেফতারের পর মুজিবনগরের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সেসময় মোহাম্মদউল্লাহ নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম বৈঠকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ। সেই বছরই শাহ আব্দুল হামিদের মৃত্যুর পর তিনি ভারপ্রাপ্ত স্পিকার হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১২ নভেম্বর তিনি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান তাঁর সভাপতিত্বেই গড়ে ওঠে এবং তাঁর স্বাক্ষরে সেই সংবিধান অনুমোদন লাভ করে। রায়পুর-লক্ষ্মীপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে পুনরায় সংসদের স্পিকার পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।  সেবছরই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালেই ২৪ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করলে তাঁর জায়গায় মোহাম্মদউল্লাহ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৪ জানুয়ারি অস্থায়ী থেকে বাংলাদেশের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেন মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী পাস হয় যেটি কিনা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করে। সেবছরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচন ছাড়াই পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি হন। মুজিবর রহমানের মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি রহমানের মন্ত্রীসভায় তিনি ভূমি প্রশাসন এবং ভূমি সংস্কার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু সেবছরই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং তারপর মোহাম্মদউল্লাহকে প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। 

১৯৮০ সালে মোহাম্মদউল্লাহ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগদান করেন। সেবছর সংসদের সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই পদের মেয়াদ মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল কারণ জেনারেল হুসেন মোহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রশাসনের ভার গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি দলের প্রতিনিধি হিসেবে চতুর্থবার সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৯৬ সালে পুনরায় তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ত্যাগ করে তাঁর পূর্ববর্তী দল আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। 

মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে সম্মানিত করেছিল। এছাড়াও ভুটানের রাজা জিগমে সিংয়ে ইনভেস্টিচার মেডেলের প্রাপক ছিলেন তিনি। 

১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর ৭৮ বছর বয়সে ঢাকায় মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহের মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান