কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা ইত্যাদি আরও বহু ক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিস্ময়কর কিছু ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটিশ অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র কিংবা ব্রিটিশের ট্রেন ডাকাতি করে সঞ্চিত অর্থ লুঠের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন বহু বিপ্লবী। তাদের বিরুদ্ধে দায়েরও হয়েছে বহু মামলা। এরকমই আরেকটি ঐতিহাসিক এবং দুঃসাহসিক অস্ত্র লুঠের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদালতে উঠেছিল রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠ মামলা (Rodda company arms heist Case)। প্রকাশ্য দিনের আলোয় কয়েকজন দুঃসাহসি বাঙালি বিপ্লবী সেকালের বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাতা রডা কোম্পানির মাউজার পিস্তল লুঠ করে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে যা ব্রিটিশ সরকারকে অত্যন্ত পীড়িত করেছিল।
১৯১৬ সালে দায়ের হওয়া এই রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠ মামলা য় অভিযুক্ত বিপ্লবীরা প্রায় সকলেই ‘আত্মোন্নতি সমিতি’র সদস্য ছিলেন। অভিযুক্তরা ছিলেন – বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি, অনুকুল চন্দ্র মুখার্জী, শ্রীশচন্দ্র পাল, গিরীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অনুকূল দত্ত, কালিদাস বসু, ভুজঙ্গ ভূষণ ধর, হরিদাস দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র মিত্র। মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান স্যার চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট।
১৯১৪ সালে কলকাতা-কেন্দ্রিক ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবসায়ী কোম্পানি ‘রডা অ্যাণ্ড কোং’ এর বেশ কয়েকটি পিস্তল ও কার্তুজ লুঠ করে কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবী এবং বাংলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের কাছে সেই অস্ত্র-শস্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। বিপ্লবী কার্যকলাপে এই সব অস্ত্র খুবই সাহায্য করেছিল ভারতীয় বিপ্লবীদের। ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদের মতো মহান বিপ্লবীরাও এই লুঠ করা পিস্তল ও অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন কাকোরি ট্রেন ডাকাতির সময়। ১৯১৬ সালের ২১ জুলাইয়ের সকালে জাকারিয়া স্ট্রিটে ২২ বছর বয়সী একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ঘনশ্যামদাস বিড়লার বাড়িতে পুলিশ হঠাৎই হানা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে পরিবারের সঙ্গে রাজস্থানের শেখাওয়াতিতে মুকুন্দরগড় গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন বিড়লা। ঐদিনই দুপুরে জি. ডি. বিড়লার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বেশ কয়েকজন তরুণ বিপ্লবীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি অস্ত্র লুঠ মামলার অভিযুক্ত হিসেবে। পুলিশ জি. ডি. বিড়লাকে পরবর্তীকালে এ বিষয়ে বহু জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তিনি আমৃত্যু অস্ত্র লুঠের ঘটনাটির সঙ্গে নিজের সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। জি ডি বিড়লাই পরবর্তীকালে ভারতের এক অন্যতম প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী হয়ে উঠবেন এবং বিড়লা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা করবেন। অক্ষয় মুকুল তাঁর লেখা ‘গীতা প্রেস অ্যাণ্ড দ্য মেকিং অফ হিন্দু ইণ্ডিয়া’ (২০১৫) বইতে এই ঘটনাটি উল্লেখ করে লিখেছেন যে জি. ডি. বিড়লার কলকাতার বাড়িতে প্রকৃতই বিপ্লবীদের অস্ত্র-শস্ত্র সংরক্ষিত থাকতো এবং রডা কোম্পানির লুঠ করা অস্ত্রও তাঁর বাড়িতেই সংরক্ষিত ছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই অস্ত্র লুঠের ঘটনা সত্যই এক বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় ১৯১৪ সাল নাগাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বেজে উঠেছে সমগ্র বিশ্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও ক্রমে এক অন্য মাত্রা পেতে শুরু করেছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই ভারতীয় বিপ্লবীদের মনের মধ্যে প্রতিবাদের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। প্রবল ব্রিটিশ অসন্তোষের এক ছাইচাপা আগুন জমে উঠেছিল সমগ্র ভারতবর্ষে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলায়। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে বহু ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করেছে বাঙালি বিপ্লবীরা। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের পরেও বিপ্লবীদের প্রতিশোধস্পৃহা একটুও কমেনি। এক সংগঠিত বৃহত্তর আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন ছিল অস্ত্র-শস্ত্র, গোলা-বারুদের। ইতিমধ্যে রাসবিহারী বসুর পরামর্শে বিপ্লবী বাঘাযতীন তিনটি অস্ত্রভর্তি জার্মান জাহাজের আসার ব্যবস্থা করেন, যদিও সেই জাহাজ ভারতের বন্দরে আসার আগেই ধরা পড়ে যায়। ফলে ঐসময় আরেক বাঙালি বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির নেতৃত্বে বাংলায় গড়ে ওঠে আরেকটি গুপ্ত সমিতি যার নাম ‘আত্মোন্নতি সমিতি’। এই সমিতি ঢাকার ‘মুক্তিসঙ্ঘ’-এর সহায়তায় কলকাতার অস্ত্র ব্যবসায়ী ‘রডা অ্যাণ্ড কোং’-এর অস্ত্রসম্ভার লুঠ করার পরিকল্পনা করে। রডা কোম্পানির আসল নাম ছিল ব্রাউন অ্যাণ্ড রডা অ্যাণ্ড কোং যারা মূলত ইংল্যাণ্ডের বার্মিংহামে অস্ত্র নির্মাণের কাজ করত। তবে রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে এই কোম্পানি মূলত ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবসার জন্যই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। লণ্ডন, বার্মিংহাম, কলকাতা সহ ভারতের আরও নানা শহরে এদের দোকান ছিল। অধুনা কলকাতার রেডক্রস প্লেসে এই রডা কোম্পানির গুদামঘর ছিল। আগে এই রাস্তার নাম ছিল ২ নং ওয়েলেসলি প্লেস যা কিনা ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছেই ছিল। ১৯১৪ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকার রডা কোম্পানির কাছে ৫০টি মাউজার সি-৯৬ অর্ধ-স্বয়ংক্রিয় পিস্তল এবং প্রায় ৪৬ হাজার মাউজার কার্তুজের অর্ডার দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ, চিন ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় থেকেই মাউজার পিস্তল একটি জনপ্রিয় অস্ত্র হয়ে উঠেছিল, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এই পিস্তল ব্যবহৃত হয়েছে। গুদাম ব্যবস্থাপক এফ. ডব্লিউ. প্রাইক ব্রিটিশ সরকারের এই অর্ডারটির কথা মাথায় রাখেন এবং সেই মত অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই কোম্পানিরই জেটি ক্লিয়ারিং কেরানি ছিলেন বাঙালি শ্রীশচন্দ্র মিত্র। তাঁরই হাতে এই পুরো অর্ডারটি সরবরাহের দায়িত্ব ছিল। প্রাইক সাহেবের অজান্তেই বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির পরিকল্পনামাফিক শ্রীশচন্দ্র মিত্র ভারতীয় বিপ্লবীদের এক গুপ্তচর হিসেবে এই রডা কোম্পানিতে কাজে ঢুকেছিলেন। শ্রীশচন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে খবর পেয়েই বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি তাঁর বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের জানিয়েছিলেন যে ‘ট্যাক্টিশিয়ান’ নামে একটি জাহাজে করে অস্ত্রশস্ত্র যাবে কাস্টম হাউজের কাছের বন্দর থেকে। রডা কোম্পানির গুদাম ঘর থেকে সেই বন্দর মাত্র ৫০০ মিটারের দূরত্বে ছিল। অধুনা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার অফিসের স্থলেই ছিল সেই কাস্টমস হাউজ। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি এবং অন্যান্য বিপ্লবীরা অস্ত্র লুঠের ব্যাপারে অনেক বৈঠক করেছিলেন কিন্তু কেউই এই পরিকল্পনাকে সায় দেননি। শেষে শ্রীশচন্দ্র পাল সকলকে বুঝিয়ে এই পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে শুরু করেন।
১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট বেলা ১১টার সময় শ্রীশচন্দ্র পাল কাস্টমস হাউজ থেকে বেরিয়ে কাগজপত্র এবং টাকা সহ রওনা দেন বন্দরের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনাটি এতই সরল ও অনাড়ম্বরভাবে করা হয়েছিল যে আগে থাকে ব্রিটিশ পুলিশ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। কেবলমাত্র একটি গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। কাস্টমস হাউজ থেকে ছয়টি গরুর গাড়িতে করে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহের কথা ছিল। বিপ্লবী অনুকূল মুখার্জী আরেকটি গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আরেক বিপ্লবী হরিদাস দত্ত এই গরুর গাড়ির গাড়োয়ান সেজে বসেছিলেন। কথামতো সব অস্ত্রশস্ত্র আর কার্তুজ সাতটি গরুর গাড়িতে বোঝাই করে দেওয়া হয়, গাড়োয়ানবেশী হরিদাস দত্ত অন্যান্য গরুর গাড়িগুলিকে নির্দেশ দিয়ে মলঙ্গা লেনের দিকে রওনা হন। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের নির্মল চন্দ্র স্ট্রীটে একটি লোহার দোকানের সামনে সব কাঠের বাক্সগুলি নামানো হয়, একটি গাড়ি এসে সব বাক্সগুলি তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সেই সময় অল্পবিস্তর বৃষ্টিও পড়ছিল, রাস্তাঘাট তাই নির্জন ছিল। ইতিমধ্যে মলঙ্গা লেনে সপ্তম গরুর গাড়িটিকে অনুসরণ করার ভাণ করে শ্রীশচন্দ্র মিত্র সোজা দার্জিলিং মেল ধরে রংপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আত্মগোপন করে থাকার জন্য। কিন্তু অন্যদিকে গাড়ি ঠিক সময় না আসায় ঘোড়ার গাড়িতে করে জেলিয়া পাড়া লেনে ভুজঙ্গ ভূষণ ধরের বাড়িতে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রের বাক্স রেখে দেওয়া হয়। এদিকে খালি কাঠের বাক্সগুলিকে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ইস্পাতের ট্রাঙ্কে করে অস্ত্রগুলি বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহের বন্দোবস্ত করা হয় সন্ধ্যেবেলায়। পরদিন সকালে পরিকল্পনামাফিক বাংলার অন্যত্র বিপ্লবী সংগঠনগুলির কাছে অস্ত্র পাঠানোর আগে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী জি. ডি. বিড়লার গুদামঘরে অস্ত্রগুলি লুকিয়ে রাখা হয়। এ ব্যাপারে গীতা প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা এবং মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান হনুমান প্রসাদ পোদ্দার অত্যন্ত সাহায্য করেছিলেন বিপ্লবীদের। ২৯ আগস্ট নাগাদ এফ. ডব্লিউ. প্রাইক লক্ষ করেন যে শ্রীশচন্দ্র মিত্র তিনদিন যাবত কাজে আসেনি। এই ঘটনাতেই সন্দেহ হওয়ায় তদন্ত শুরু করলে কয়েকদিনের মধ্যেই অস্ত্র লুঠের খবর প্রকাশ্যে আসে। ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় শিরোনাম ছাপা হয় ‘গ্রেটেস্ট ডে-লাইট রবারি’।
এই মামলার দায়িত্বে ছিলেন স্যার চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট। ঘোড়ার গাড়িগুলির হদিশ পাওয়ার পর একের পর এক সূত্র ধরে তিনি বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করেন। ঘোড়ার গাড়ির চালকদের মুখ থেকেই মূলত সব তথ্য বেরিয়ে আসে। এই পরিকল্পনার মুখ্য শ্রীশচন্দ্র মিত্র ওরফে হাবুকে পুলিশ ধরতে পারেনি, তিনি যে সেই রংপুরে পালিয়ে গেলেন, তারপর তাঁর আর হদিশ মেলেনি। মামলায় অভিযুক্ত কালিদাস বসু, নরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ভুজঙ্গ ভূষণ ধরের দুই বছরের কারাবাস, হরিদাস দত্তের চার বছরের কারাবাস ঘোষিত হয় মামলায়। এর তিন বছর পরে শ্রীশচন্দ্র পাল এবং খগেন দাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হনুমান প্রসাদ পোদ্দার এবং জি. ডি. বিড়লাকেও এই মর্মে সন্দেহ করা হলে মাড়োয়ারি সহায়ক সমিতির বদান্যতায় পুলিশ তাঁদের কখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এই রডা কোম্পানির অস্ত্র লুঠের ঘটনার ফলশ্রুতিতে স্যার সিডনি রাওলাট সেডিশন কমিটির প্রতিবেদনের ৫৬ নং পাতায় উল্লেখ করেছিলেন যে ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসের এই ঘটনার পরে যতগুলি ব্রিটিশ হত্যা বা হত্যার চেষ্টা, ডাকাতির প্রয়াস দেখা গেছে প্রায় সবেতেই এই মাউজার পিস্তল ব্যবহার হয়েছে। আর এরপর থেকেই তিনি কুখ্যাত রাওলাট আইন জারি করেন।