বর্তমান ব্যারাকপুর – টিটাগড় অঞ্চলের আগে নাম ছিল চানক। সেখানে রানী রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অনুরূপ একটি মন্দির গড়েছিলেন, যা স্থানীয়দের কাছে সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির বলে পরিচিত। তৎকালীন চানকে গড়ে উঠেছিল বলে মন্দিরটিকে চানক মন্দিরও বলা হয়।
প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে ১৮৪৭ সালে কলকাতার জানবাজারের রানী রাসমণিদেবী কাশীতে অন্নপূর্ণা দর্শনের জন্য যাত্রা করছিলেন। তীর্থযাত্রার ঠিক আগের দিন রাতে রানী দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পান যে তারঁ কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলে দেবী সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই পূজা গ্রহণ করবেন। তখন রানী দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
তাঁরা কাশীতে যেহেতু অন্নপূর্ণা দর্শনে যাচ্ছিলেন, তাই রানী রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের ইচ্ছে ছিল যদি দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায় যদিও নিজের জীবনকালে তিনি তা করে যেতে পারেননি। তবে তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বা। তিনি হুগলী নদীর তীরে তৎকালীন চানক নগরে (বর্তমান ব্যারাকপুর) দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি করলেন দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির, স্থানীয়দের কাছে যা সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির বলে পরিচিত। বলা হয় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাজে যে কারিগরেরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণে যুক্ত ছিলেন। মন্দির তৈরিতে সেই সময়ে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। ১৮৭৫ সালের ১২ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়। মন্দিরের মূল দরজার উপর যে সিংহমূর্তিটি রয়েছে, ব্রিটিশ প্রশাসন সেটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল সিংহমূর্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক। তাই মন্দির কর্তৃপক্ষ এটি ব্যবহার করতে পারবে না। তবে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের রায়ে সিংহমূর্তিটি রয়ে যায় এবং আজও সেখানেই আছে। মন্দিরের কাছে গঙ্গার যে ঘাটটি আছে তা রানী রাসমণি ঘাট নামে পরিচিত। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ শিখ সৈন্যদের সঙ্গে স্নান করেছিলেন।
সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণের পর মন্দিরের পূজার ব্যয় বহনের জন্য জগদম্বাদেবী সেই সময়ে তাঁর সম্পত্তি থেকে একটি ‘অর্পণনামা’ করেছিলেন। সেই ‘অর্পণনামা’ অনুসারে বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ মন্দিরের সেবায়েত হতে পারবে। তবে বর্তমান সেবায়েতদের থেকে জানা যায় যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে মন্দিরের আয় অনেক কমে যায় এবং মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নিয়ে অনেক সমস্যা দেখা যায়। সরকার বা কোন গোষ্ঠীই ঐতিহাসিক এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসেনি। বর্তমানে পুরো মন্দির চত্বর জুড়েই এই দৈন্যদশা লক্ষ্য করা যায়।
পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করার মূল প্রবেশদ্বারের মাথায় রয়েছে একটি সিংহের মূর্তি, যার কথা আগেই বলা হয়েছে। অবিকল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে তৈরি সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। মন্দিরে ওঠবার জন্য দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে সিঁড়ি আছে। দক্ষিণেশ্বরের মতই এখানেও রয়েছে আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত শিবমন্দির। তবে এখানে শিবমন্দিরের সংখ্যা ছয়। এদের নাম হল যথাক্রমে কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর ও কপিলেশ্বর। এছাড়াও মন্দির চত্বরে রয়েছে নাট মন্দির, দু’টি নহবৎখানা, ভোগের ঘর ইত্যাদি।
মন্দিরের ভেতরে শ্বেতপাথরের বেদীর উপর রুপোর তৈরী সিংহাসনে রাখা দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি। তাঁর ডান হাতে অন্নদান করার হাতা এবং বাঁ হাতে অন্নপাত্র। তাঁর পাশে শিবের মূর্তি। চালচিত্র ও সিংহাসন রুপোর তৈরি। সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির নাম হলেও মূর্তিগুলো অষ্টধাতুর তৈরি। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে অন্নপূর্ণার মূর্তি তৈরি হয়েছে তিনভাগ সোনা ও একভাগ অষ্টধাতু দিয়ে। শিবমূর্তি তৈরি হয়েছে একভাগ সোনা আর তিনভাগ অষ্টধাতু দিয়ে।
অন্নপূর্ণা পূজা এখানের প্রধান উৎসব। তাছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির দিন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস, মঙ্গলচণ্ডী পূজা, বিপত্তারিণী পূজা, অম্বুবাচী, কালীপূজা এইসব দিনে প্রচুর ভিড় হয়। প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতেও এখানে বিশেষ পূজা হয়। দেবী অন্নপূর্ণার ভোগে মাছ দেওয়া হয়। আগে পাঁঠাবলিও হত তবে এখন তা বন্ধ। উৎসবের দিনগুলো ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো মন্দির প্রায় ফাঁকাই থাকে।