তারাপীঠ ভ্রমণ

তারাপীঠ ভ্রমণ

বাঙালি তথা ভারতীয়দের মনের অন্তঃস্থলে একটি আধ্যাত্মিক মন বিরাজ করে। আবার নানাস্থানে ভ্রমণের নেশাও মানুষের মজ্জাগত। এই দুইয়ের একটি চমৎকার মেলবন্ধন ঘটতে পারে তারাপীঠে। তাছাড়া তারাপীঠ হল শক্তিপীঠগুলির অন্যতম একটি। এখানে সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল বলে মনে করা হয়। কেবল তারাপীঠ মন্দিরটিই নয়, তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন মন্দিরগুলিতেও ঘুরে আসলে নিঃসন্দেহে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি সঞ্চয় করা যাবে।

তারাপীঠ মন্দিরচত্বর। ছবি ইন্টারনেট

বীরভূম জেলার সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছোট গ্রাম হল তারাপীঠ। দ্বারকা নদীর তীরে এটি অবস্থিত। রামপুরহাট মহকুমার সদর রামপুরহাট শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে তারাপীঠ মন্দিরের অবস্থান। দ্বারকা নদীর পুর্বদিকে অবস্থিত চন্ডীপুরই আজকের তারাপীঠ। বোলপুর থেকে তারাপীঠের দুরত্ব ৬০ কিলোমিটার এবং কলকাতা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার।

এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। প্রথম জনশ্রুতি অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। তারাপীঠে সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল বলে মনে করা হয়। অন্য জনশ্রুতি অনুযায়ী বশিষ্ট তারা মায়ের দর্শন লাভের জন্য কঠিন তপস্যা শুরু করেন। তারপর তিনি বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। বুদ্ধ বশিষ্টকে “তারা” পুজোর পদ্ধতি শেখান। এরপর বুদ্ধের পরামর্শ মত তিনি তারাপীঠে গিয়ে সাধনা করেন এবং মায়ের দর্শন লাভ করেন। অন্যান্য আরও জনশ্রুতি বা এই মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন এখানে

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

আধ্যাত্মিকতা এবং প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির মেলবন্ধনের স্বাদ পাওয়ার জন্য পর্যটকদের কাছে তারাপীঠ একটি উপযুক্ত ভ্রমণস্থল হতে পারে। এই জায়গার মূল আকর্ষণই তারা মায়ের মন্দির। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িত সাধক বামাক্ষ্যাপার কিংবদন্তিও অনেক কৌতুহলী মানুষকে টেনে আনে এখানে। তারাপীঠের আরেকটি মূল আকর্ষণ হল সেখানকার মহাশ্মশান। সে-জায়গাটি তান্ত্রিক সাধকদের সাধনভূমি স্বরূপ। ফলে পর্যটকদের যে বেশ এক রোমহষর্ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই তারাপীঠে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তারাপীঠের নিকটতম রেলস্টেশন হল রামপুরহাট। হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রামপুরহাট জংশন স্টেশনের প্রচুর ট্রেন পাওয়া যায়। রামপুরহাট নেমে সেখান থেকে তারাপীঠ পৌঁছনোর জন্য ট্যাক্সি পরিষেবা রয়েছে। বাসে আসতে চাইলে কলকাতার ধর্মতলা চত্বর থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা প্রাইভেট প্রচুর বাস পরিষেবা পাওয়া যায় তারাপীঠ যাওয়ার জন্য। নিজের গাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ে, ন্যাশানাল হাইওয়ে ১১৪ এইসব রাস্তা ধরে তো যাওয়া যায়ই, তাছাড়াও বীরভূম থেকে রাজ্য সড়ক ১৩ ধরে গেলেও পৌঁছে যাওয়া যাবে তারাপীঠে।

তারাপীঠে ভক্ত ও পর্যটক সমাগমের মাত্রা বরাবরই এতবেশী যে এর চারদিকে বসবাসের জন্য নানারকম হোটেল রয়েছে। তারাপীঠে বিভিন্নরকম খরচে থাকবার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। বুক করবার আগে অবশ্যই হোটেলগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নেবেন। এছাড়া অনেকে শান্তিনিকেতনের হোটেলে থেকে এখানে একদিনের জন্য ঘুরতে বা পুজো দিতে আসেন।

তারাপীঠের প্রধান দুই আকর্ষণ হল মায়ের মন্দির এবং মহাশ্মশান।

মায়ের মূর্তি। ছবি ইন্টারনেট

তারা মায়ের মন্দির – মন্দিরটি মার্বেল এবং টেরাকোটার মিশ্রণে নির্মিত। প্রধান মন্দিরের পথে বেশ অনেকগুলি দৈত্যাকার দরজাও পড়ে, যেগুলি মূলত ধাতু দ্বারা নির্মিত। সেগুলির ওপরে আবার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীকের জটিল নকশা খোদাই করা আছে দেখা যায়। এইসব নির্মাণশৈলীও যে-কোনো শিল্পবোদ্ধার কাছে এক উপরি পাওনা। মন্দিরটি উত্তরমুখী। এই মন্দিরের স্থাপত্যতে গ্রাম বাংলার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। মন্দিরটি চারচালার ধাঁচে নির্মিত ও এর চার কোণে চারটি চূড়া রয়েছে। মা তারার আসল যে পাথরের মূর্তি রয়েছে সেটি তিন ফুট উঁচু একটি ধাতব মূর্তির আবরণের মধ্যে রাখা থাকে। এই ধাতব মূর্তির রূপটি হল মা চতুর্ভুজা, এলোকেশী,কপালে সিঁদুর লেপা, লাল জিহ্বা, পরনে লাল শাড়ি আর মাথায় রয়েছে রূপার মুকুট। এবং বিগ্রহের নিচে রাখা থাকে দুটি রূপার পাদ পদ্ম।যেখানে ভক্তরা তাদের মনের ইচ্ছা জানিয়ে মা তারার উদ্দশ্যে পুজো দিয়ে থাকে। এই মূর্তির ছবিটিই “তারামা” রূপে সবার ঘরে পূজিত হয়।

মহাশ্মশান – মন্দির সংলগ্ন মহাশ্মশানে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর এবং গা ছমছমে অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। নিস্তব্ধ, নির্জন সেই মহাশ্মশানই কত তান্ত্রিক সাধকদের আস্তানা, সাধনস্থল। বলা হয় যে, এই শ্মশানে সাধনা করে খুব সহজেই সিদ্ধিলাভ করা যায়। বামাক্ষ্যাপার সাধনার কাহিনী সেই প্রসঙ্গেই চলে আসে।

তারাপীঠ মন্দির এবং তৎসংলগ্ন মহাশ্মশান ছাড়াও তার চারপাশে আরও এমন বহু প্রাচীন মন্দির রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সেসব মন্দিরে ভ্রমণ করাও বেশ সহজ তারাপীঠ থেকে। প্রথমত, বামাক্ষ্যাপার মন্দির। গোলাপী ও লালরঙের এই মন্দির তান্ত্রিক সাধক বামাক্ষ্যাপাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। মন্দিরের বাইরেই রয়েছে একটি সমাধি সেখানে বহু মানুষ এসে সাধুর নামে প্রার্থনা করে এবং নৈবেদ্য দেয়।

এছাড়া তারাপীঠ মন্দির থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বীরভূমের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি মল্লারপুর শিবমন্দির। প্রায় ৮০০ বছরের পুরোনো এই মন্দিরের চারদিকে মোট ২১টি পুকুর রয়েছে। তারাপীঠ থেকে ওই ১০ কিমির দূরত্বেই আবার রয়েছে বীরচন্দ্রপুর মন্দির। এটি বৈষ্ণবধর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্বামী নিত্যানন্দের জন্মস্থান বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরের ইতিহাস আনুমানিক ৩০০ বছরেরও বেশি। বীরচন্দ্রপুরে আরও কিছু পুরোনো মন্দির যেমন আছে তেমনি রয়েছে  ইসকন মন্দির। এছাড়াও কামদেব ব্রহ্মাচার্য দ্বারা নির্মিত প্রায় ৫০০ বছর প্রাচীন লক্ষ্মী মন্দিরও একটি দ্রষ্টব্য স্থান।

এছাড়াও তারাপীঠ থেকে আরও তিনটি শক্তিপীঠ ঘুরে আসা যায়। সেগুলো হল বক্রেশ্বর, নলহাটেশ্বরী এবং কঙ্কালীতলা। তারাপীঠ থেকে শান্তিনিকেতনেও যাওয়া যায়।

তারাপীঠে সারা বছর ধরেই আসা যায়। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে গেলে এক মনোরম আবহাওয়ায় সুন্দর একটি ভ্রমণ হতে পারে। এখানে বিভিন্ন সময়ে নানারকম উৎসব চলে। সংক্রান্তির সময়ে সেখানে সংক্রান্তির মেলা হয়, ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে দোলপূর্ণিমার আয়োজন হয়, মার্চ-এপ্রিলের দিকে হয় বাসন্তিকা পরব, পালিত হয় গামা পূর্ণিমা। জুলাই-আগস্টের সময়, চৈত্র মাসের প্রতি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র পর্ব। মন্দিরে আয়োজিত আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসব হল কৌশিকী অমাবস্যা যা প্রতি বছর আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।


ট্রিপ টিপস

  • কীভাবে যাবেন – ট্রেনে করে রামপুরহাট জংশন স্টেশনে নেমে সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া যায় তারাপীঠে। তাছাড়াও ধর্মতলা চত্বর থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বা প্রাইভেট প্রচুর বাস পরিষেবা পাওয়া যায়। আবার প্রাইভেট গাড়িতে পানাগড়-মোরগ্রাম বা এনএইচ ১১৪ ধরে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে তারাপীঠ।
  • কোথায় থাকবেন – প্রায় সারা বছরই প্রচুর ভক্ত ও পর্যটকের ভিড় হওয়ার কারণে এখানে অনেক হোটেল গড়ে উঠেছে।
  • কী দেখবেন – তারাপীঠ মন্দির এবং মহাশ্মশান মূল দ্রষ্টব্য। এছাড়াও আশেপাশে বামাক্ষ্যাপা মন্দির, মল্লারপুরের শিবমন্দির, বীরচন্দ্রপুর মন্দির, বক্রেশ্বর মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, বোলপুর শান্তিনিকেতন, কঙ্কালীতলা মন্দির ইত্যাদি সাইট সিইং হিসেবে দেখা যায়।
  • কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে আসা যায়। তবে সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে গেলে বেশ মনোরম আবহাওয়ায় ঘুরতে পারা যাবে।
  • সতর্কতা
    • মন্দিরে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হবে।
    • মন্দিরের ভিতরে কোনো পোষা প্রাণী নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই।
    • মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।

One comment

আপনার মতামত জানান