সমগ্র পৃথিবীতে প্রধান খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য হল ভাত (Cooked Rice)৷ মূলত এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাত সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেও সারা পৃথিবী জুড়েই প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাত খাওয়ার প্রচলন আছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কেরালা সহ অধিকাংশ রাজ্য এবং বাংলাদেশের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য হল ভাত। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই যেহেতু ধান চাষ বহুলাংশে হয়ে থাকে তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানকার মানুষের খাদ্য তালিকায় ভাত প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ভাত শর্করা জাতীয় খাদ্য৷ চাল সেদ্ধ করে ভাত রান্না করা হয়৷ এই ভাত তরকারি সহযোগে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এছাড়া পোলাও, খিচুড়ি, পায়েস, বিরিয়ানির মতন সুস্বাদু রন্ধনপ্রণালী ভাতের মাধ্যমে তৈরি হয়। এখন জেনে নেওয়া যাক খাদ্য হিসেবে ভাতের প্রচলন হল কীভাবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসারে আজ থেকে মোটামুটি ৮২০০ থেকে ১৩৫০০ বছর আগে চিন দেশের ইয়াংজে (Yangtze) নদী অববাহিকায় প্রথম ধান চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। চীন দেশে ধান চাষ শুরু হলেও ক্রমে ক্রমে তা এশিয়ার বৃহত্তর ভাগ এবং গ্রীস, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, ব্রাজিল, স্পেন, উত্তর অফ্রিকা হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে৷ ভারতবর্ষে ধান চাষের ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন। এতদিন মনে করা হত ভারতে ধান চাষ শুরু হয় দুই হাজার খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের যৌথ গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে গবেষকরা দাবি করেছেন ভারতে ধান চাষের প্রচলন আরও আগে থেকে ছিল। হরিয়ানার হিসার জেলার রাখিগারহি থেকে প্রাপ্ত ধানের বয়স নির্ণয় করে এই গবেষকরা দেখেছেন তা অন্তত দুই হাজার চারশো বছর প্রাচীন।
ভাতের সঙ্গে প্রাচীন লোককথার বেশ কিছু কাহিনী জড়িত আছে৷ ভাত কেবল ভারতবর্ষ নয়, অন্যান্য দেশের খাদ্যাভাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে৷ মায়ানমারের লোককথা অনুযায়ী ঈশ্বর মায়ানমারের অধিবাসী কোচিনদের হাতে ধানের বীজ দিয়ে বলেন সেখানে এই ধানের বীজ ফেলতে জীবনযাত্রা যেখানে স্বচ্ছল। বালি দেশের প্রাচীন লোককথা অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণু ধানের জন্ম দেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র শিক্ষা দেন কীভাবে তা চাষ করতে হবে৷ আর চীনে ধান পশুদের উপহার রূপে গণ্য করা হয়৷ চীন দেশীয় কিংবদন্তি অনুসারে একসময় বন্যায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কোনও খাবারই অবশিষ্ট ছিল না। কেবল একটি কুকুরের লেজে ধানের বেশ কিছু দানা লেগে ছিল৷ কুকুরটি ক্ষেতে গেলে লোকেরা সেই বীজ দেখতে পায় এবং সেই বীজ রোপণ করে। ক্রমে ক্রমে ধানে ভরে ওঠে চারিদিক। এমনভাবেই মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়৷
এবার দেখা যাক ‘ভাত’ কথাটির উৎপত্তি হল কীভাবে। ‘ভাত’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘ভক্ত’ থেকে। সংস্কৃত ‘ভক্ত’ শব্দটি থেকে প্রাকৃত শব্দ ‘ভত্ত’ এর আগমন। কালক্রমে এই ‘ভত্ত’ থেকেই বাংলা ‘ভাত’ শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃত ‘ভক্ত’ শব্দের অর্থ আসলে ‘ভাগ’ করা বোঝায়। প্রাচীন বাংলায় পরিবারের প্রধান পরিবারের সকলকে সমানভাবে খাবার ও রসদ ভাগ করে দিতেন। প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাপ্য অংশই হল তার ‘ভক্ত’। এই ভাগ করে দেওয়া বস্তুর মধ্যে ভাত ছিল প্রধান। তাই ভক্ত শব্দের একটি অর্থ হল ভাত। প্রাচীন বাংলায় ভাত ‘ওদন’ নামেও পরিচিত ছিল। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে এক জায়গায় লিখেছেন – “তৈলবিনা কৈলস্নান/করিলু উদকপান/শিশু কাঁদে ওদনের তরে।” বেশকিছু বাঙালি লোকাচারেও ভাত শব্দটি নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছে। যেমন – বৌভাত, আইবুড়োভাত ইত্যাদি।
বাংলায় ভাতের প্রতিশব্দ – ‘অন্ন”। সংস্কৃতে ‘অন্ন’ শব্দটির অর্থ – সব ধরণের খাদ্য। অর্থাৎ অন্ন শব্দটির মূল অর্থ ধরলে অন্ন বলতে ভাত` যেমন বোঝায় তেমনি রুটিও বোঝায়। সংস্কৃতে অন্নের চারটি রূপ রয়েছে – ভক্ষ্য (চর্ব্য), ভোজ্য, লেহ্য ও পেয়। এই অন্ন শব্দ থেকে এসেছে অন্নকূট উৎসব এবং অন্নপ্রাশন। ঋগ্বেদে অন্নের অন্তত চোদ্দটি প্রতিশব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় যথা – ‘অন্ন’, ‘অন্ধস্’, ‘ইষ’, ‘বাজ’, ‘পৃক্ষ’, ‘পিতু’, ‘ভক্ত’, ‘শ্রবস্’, ‘স্বধা’, ‘ঊর্জ’, ‘ইলা’, ‘চন’, ‘নমস্’ ও ‘বয়স্’।
ধান থেকে চাল এবং তার থেকে ভাতের উৎপত্তি৷ ধান থেকে চাল তৈরি হওয়ার পদ্ধতি অবলম্বনে চাল দুই প্রকার হয় ১. আতপ চাল ২. সেদ্ধ চাল৷ ভাত রান্নার কৌশল নিয়ে একটি লোক-বচন এক সময় খুব চালু ছিল – “চাউল দিবে যত তত।/ জল দিবে তার তিন তত।।/ ফুটলে দিবে ভাতে কাঠি। তার পর দাও জ্বালে ভাটি ।।”
ভাত রান্নার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ভাতের ফেন। ‘ফেনা’ থেকে এই ‘ফেন’ শব্দটির উৎপত্তি। চাল ফোটানোর সময় অনেক সময় চালের দানা ফেটে গিয়ে তার মধ্যে থাকা শ্বেতসার জলে মিশে যায়। এই শ্বেতসার মিশ্রিত জলীয় অংশকে বলে ফেন। ভারতে সাধারণত ফেন ছেঁকে ফেলে দিয়ে ভাতকে ঝরঝরে শুকনো করে খাওয়া হয়।
ভাতকে অনেকটা জল দিয়ে অনেক ক্ষণ ধরে ফোটালে বেশির ভাগ ভাত গলে গিয়ে ভাতের ফেনের মধ্যে মিশে গিয়ে বেশ ঘন শ্বেতসারের স্তর তৈরি করে। জামা কাপড় ইস্ত্রি করার আগে তাকে কড়কড়ে করার জন্য মাড়ে ভিজিয়ে শুকানো হয়। একে ‘মাড় দেওয়া’ বলে। সংস্কৃত ‘মণ্ড’ থেকে ‘মাড়’ শব্দটি এসেছে।
মুঘল ও ইংরেজ আমলে বাঙালি প্রথায় ভাত রান্নার সাথে সাথে বাঙালি রান্নাঘরে মুসলমান কায়দায় ভাত রান্না করার পদ্ধতিও প্রবেশ করেছে। পোলাও, বিরিয়ানি, খুসকা, তাহেরি, ফ্রায়েড রাইস তার অন্যতম উদাহরণ।
সংস্কৃত শব্দ ‘পলান্ন’ থেকে ‘পোলাও’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। সংস্কৃতে ‘পল’ শব্দের মানে ‘মাংস’। পল অর্থাৎ মাংস মিশ্রিত ভাতই হল পলান্ন যা আজ পোলাও নামে পরিচিত। অনেক ঐতিহাসিক পোলাওকে মুসলমান রান্না হিসেবে দাবি করলেও অল্প ঘি দিয়ে পোলাও রান্না করা হলে সেই পোলাওকে খুসকা বলা হয়। এটি মূলত মুসলমানি একটি রন্ধন প্রণালী। অল্প মশলা সহযোগে পোলাও রান্না হলে তা তিহারি নামে প্রচলিত। ঢাকার একটি বিখ্যাত জলখাবার হল তিহারি। গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ তাঁর ‘প্রাচীন শিল্প পরিচয়’ নামক গ্রন্থে এই দাবির বিরোধিতা করে দাবি করেছেন মুসলমান শাসনের আগেই ভারতে পোলাও রান্নার চল ছিল। প্রাচীন ভারতে এই মাংস সুদ্ধু ঘি ভাত ‘সর্পিস্বৎ’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া এর আরও একটি নাম ছিল ‘পললৌদন’।
ভাতের সাথে মাংস মিশিয়ে তৈরি এক ধরণের পোলাও হল বিরিয়ানি। মূলত মুঘল আমলে এই বিরিয়ানির উদ্ভব বলে অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা। ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ আর ‘বিরিঞ্জ’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘বিরিয়ানি’ শব্দের। ‘বিরিয়ান’ শব্দের অর্থ -রান্নার আগে ভেজে নেওয়া আর ‘বিরিঞ্জ’ অর্থ – চাল। অর্থাৎ রান্নার আগে ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া সুগন্ধি চালই হল বিরিয়ানি।
ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতীয় রান্নাঘরে এই ফ্রায়েড রাইস বা ভাজা ভাতের প্রবেশ। ব্রিটিশদের হাত ধরে এলেও এই পদটি আদতে চাইনিজ একটি পদ। সুগন্ধি বাসমতি চালের ভাত তেল বা ঘি সহযোগে সামান্য ভেজে তার সঙ্গে ছোটো করে কাটা সেদ্ধ মাংস বা সবজি মিশিয়ে যে পদটি তৈরী হয় সেটিই ফ্রায়েড রাইস।
তবে সব ধরণের রাঁধা ভাতের মধ্যে সবচেয়ে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ভাত হল পান্তা ভাত। বাংলায় যা পান্তা ভাত আসামে তাই ‘পঁইতা ভাত’ ও ওড়িশাতে ‘পোখালো’ । সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখা বাসি ভাত হল পান্তা ভাত। পরদিন সকালে নুন, কাঁচালঙ্কা সহযোগে এটি খাওয়া হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম বাংলায় পয়লা বৈশাখ এবং রান্নাপুজোর আবশ্যিক পদ হল এই পান্তা ভাত। পান্তাভাতের ওপর আসাম কৃষি বিদ্যালয়ের করা সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০০ গ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ৪৭৫ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে সেখানে পান্তাভাতে এর পরিমাণ ৩০৩ মিলিগ্রাম। পান্তাভাতে পটাশিয়ামের পরিমান ৮৩৯ মিলিগ্রাম। ১০০ গ্রাম সাধারণ ভাতে ক্যালসিয়াম থাকে যেখানে ২১ মিলিগ্রাম সেখানে পান্তাভাতে ক্যালসিয়ামের পরিমান ৮৫০ মিলিগ্রাম। তাই হয়ত ‘পকেট হারকিউলিস’ মনোহর আইচ বলতেন – “পান্তা ভাতের জল, তিন জোয়ানের বল। ”
ভারতবর্ষসহ সারা বিশ্বে খাদ্য হিসেবে ভাতকে আমরা দেখতে পাই৷ ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে মূলত সেদ্ধ চাল খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় বাকি সব জায়গায় আতপ চালের চলই বেশি৷ ঝরঝরে ভাত তরকারি কিংবা ডাল সহযোগে ভারতে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে চীন কোরিয়া জাপানের মতন দেশগুলিতে চটচটে আঠালো ভাতের মন্ড (স্টিকি রাইস) করে খাওয়ার রীতি প্রচলিত।
সাহিত্য সমাজের দর্পণ, সমাজের সেই ছবি খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদে আছে ভাতের উল্লেখ, ‘হাঁড়িত ভাত নাহি, নিতি আবেশি’। বিজয়গুপ্ত তাঁর ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন ‘আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিল পান্তা ভাত’। কবি ঈশ্বরগুপ্ত তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন ‘ভাত বিনে বাঁচিনে, আমরা ভেতো বাঙ্গালী’। প্রাকৃত ভাষায় রচিত আনুমানিক চতুর্দশ শতকের বই ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’-এ তৎকালীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের যে বর্ণনা রয়েছে তা অনেকটা এরকম – ‘ওগ্গর ভত্তা রস্তুম পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুত্তা’। অর্থাৎ কলা পাতায় গরম ফেনা ভাত গরুর দুধ থেকে তৈরী ঘিয়ের সাথে খাওয়া ছিল সেকালের বাঙালির সাধারণ রেওয়াজ। আবার মধ্যযুগে বৃন্দাবন দাস রচিত ‘চৈতন্য ভাগবত’ গ্রন্থে নিতাই গৌরাঙ্গের খাবার হিসেবে ‘দিব্য অন্ন ঘৃত দুগ্ধ পায়স’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
সাহিত্যে হোক বা জীবনে, হেঁশেলে হোক কিংবা আচার অনুষ্ঠানে ভাতকে বাদ দিয়ে বঙ্গ জীবন অসম্পূর্ণ। কেবল বাংলা নয় সারা ভারত তথা পৃথিবীতে ভাত তার আধিপত্য বিস্তার করেছে নীরবে। ভাতের যে এত বৈচিত্র্য থাকতে পারে তা বোধকরি ভাত না খেলে বোঝা যাবে না।
তথ্যসূত্র
- বাঙালির খাদ্যকোষ, মিলন দত্ত, দে'জ পাবলিশিং - অধ্যায় - অন্ন, পৃষ্ঠা -১৫, অধ্যায় - ভাত, পৃষ্ঠা - ২৯২
- https://en.wikipedia.org/
- https://timesofindia.indiatimes.com/
- https://labs.plb.ucdavis.edu/
- https://historytouch.com/
- https://archive.ph/
- https://earthstoriez.com/
- https://draminbd.com/
- https://en.wikipedia.org/