মহাভারতের দ্রোণপর্বে ৭৩তম অধ্যায়ে অর্জুনের জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা র কথা বর্ণিত আছে। অর্জুন এবং সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যুকে হত্যা করার জন্য জয়দ্রথই চক্রব্যূহের প্রবেশ পথ আটকেছিলেন এবং পান্ডব সৈন্যদের ভিতরে ঢুকতে দেননি। সেই রাগেই মূলত অর্জুনের জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা ।
ভীষ্মের পতন হওয়ার পর দ্রোণাচার্য কৌরবপক্ষের সেনাপতি হলেন। দুর্যোধন তখন দ্রোণের কাছে দাবি করলেন যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত ধরে এনে দিতে হবে। দ্রোণ দুর্যোধনকে কথা দিলেন যে তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করবেন যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনার। অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তৈরি হল ‘সংশপ্তক’ নাম পঞ্চাশ হাজার সৈন্যদলের এক বিরাট বাহিনী। কিন্তু পরপর দুইদিন ধরে ভয়ানক যুদ্ধ করেও দ্রোণ অর্জুনকে হারিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনতে পারলেন না। এতে দুর্যোধন ভীষণ রেগে গিয়ে দ্রোণকে সাংঘাতিক অপমান করলেন। দ্রোণ তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে পরের দিন তিনি এক ভয়ঙ্কর ব্যূহ তৈরি করে পান্ডবপক্ষের এক মহারথকে বধ করবেন।
সেই মত পরের দিন অর্থাৎ যুদ্ধের তেরোতম দিনে দ্রোণ তৈরি করলেন ‘চক্রব্যূহ’ নামে চাকার মত দেখতে এক বিশাল ব্যূহ। সংশপ্তকরা অর্জুনকে সরিয়ে নিয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যদিকে। ফলে চক্রব্যূহে ঢুকতে না পেরে বিপদে পড়ে গেলেন পান্ডবরা। কারণ এই ব্যূহে ঢোকার সঙ্কেত জানা ছিল কেবল কৃষ্ণ, কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যুম্ন, অর্জুন আর অভিমন্যুর। অগত্যা বাধ্য হয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে চক্রব্যূহে ঢুকতে অনুরোধ করলেন। আরও বললেন, অভিমন্যু রাস্তা বানিয়ে দিলে তাঁরা সবাই এক এক করে ব্যূহে ঢুকে যুদ্ধ করবেন। অভিমন্যু তখন চক্রব্যূহে ঢুকলেন। কিন্তু পান্ডবরা কেউই তাঁর সঙ্গে ঢুকতে পারলেন না। ব্যূহের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন জয়দ্রথ। তিনি একাই যুদ্ধ করে চারজন পান্ডবকে ফিরিয়ে দিতে লাগলেন। জয়দ্রথ মহাদেবের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে তিনি অর্জুন ছাড়া বাকি চারজন পান্ডবকে যুদ্ধে হারাতে পারবেন। সেই বরের জোরে জয়দ্রথ সেদিন চারজন পান্ডব ও পান্ডবসৈন্যদের চক্রব্যূহে ঢুকতে দিলেন না।
ওদিকে অভিমন্যু একাকী চক্রব্যূহে ঢুকে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কিছুতেই কৌরবরা তাঁকে হারাতে পারছিলেন না। তখন দ্রোণের পরামর্শে কর্ণ, দুর্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, শকুনি প্রভৃতিরা একসঙ্গে অভিমন্যুকে আক্রমণ করলেন। একে একে অভিমন্যুর ধনুক, সারথি, রথ, রথের ঘোড়া সবই তাঁদের বাণে কাটা গেল। তখন অভিমন্যু ঢাল ও তলোয়ার হাতে যুদ্ধ শুরু করলেন। কিন্তু দেখতে দেখতে তাও কাটা গেল। এই দেখে অভিমন্যু গদা নিয়ে দুঃশাসনের ছেলে দ্রুমসেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ ভীষণ যুদ্ধের পর দ্রুমসেন অভিমন্যুর মাথায় গদাঘাত করেন। সেই আঘাতেই মৃত্যু হয় অভিমন্যুর।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় যুদ্ধ শেষে অর্জুন শিবিরে ফিরে অভিমন্যুকে দেখতে পেলেন না। অমঙ্গল আশঙ্কায় তাঁর বুক কেঁপে উঠল। এরপর শিবিরে ঢুকে তিনি অভিমন্যুর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে ভীষণ শোকে জ্ঞান হারালেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সম্পূর্ণ কথা জানতে পেরে তিনি রাগে জ্বলে উঠলেন। তখনই অর্জুন আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, “মহারাজ! আমি সত্য করে বলছি, কাল আমি জয়দ্রথকে বধ করব। যদি জয়দ্রথ প্রাণের ভয়ে দুর্যোধন ও তার ভাইদের ত্যাগ করে নিজের রাজ্যে ফিরে না যায়, যদি সে কৃষ্ণের বা আপনার শরণাপন্ন না হয়, তবে সে নিশ্চয়ই আমার হাতে প্রাণত্যাগ করবে। সেই পাপী আমাদের আত্মীয়তা ভুলে গিয়ে আমার ছেলে অভিমন্যুকে বধ করতে দুর্যোধনকে সাহায্য করেছে, আমি তাকে অবশ্যই বধ করব। আমি যা প্রতিজ্ঞা করলাম, সেই কাজ যদি আমি করতে না পারি, তবে যেন আমার স্বর্গলাভ না হয়। যদি আমি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তবে যেন আমি মাতৃহত্যাকারী, পিতৃহত্যাকারী, গুরুপত্নী গমনকারী, সাধুদের নিন্দাকারী, গচ্ছিত সম্পদের অপহারক, বিশ্বাসঘাতক, ব্রহ্মহত্যাকারী, গোহত্যাকারী, বৃথা খাদ্য ভোজী এবং ব্রহ্মা, বৃদ্ধ ও গুরুর অপমানকারী ব্যক্তি যে লোকে যায়, আমি যেন মৃত্যুর পর সেই লোকে গিয়ে বাস করি। যদি আমি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি তবে যে ব্যক্তি পা দিয়ে ব্রাহ্মণ, গরু ও আগুন স্পর্শ করে এবং যে ব্যক্তি জলে মল ও মূত্র ত্যাগ করে, আমি যেন সেই ব্যক্তিদের মত গতি লাভ করি। যদি আমি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি তবে যে ব্যক্তি নগ্ন হয়ে স্নান করে, যার কাছ থেকে অতিথি অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়, যে ব্যক্তি ঘুষ খায়, মিথ্যা কথা বলে ও প্রবঞ্চনা করে, যে ব্যক্তি নিজের চাকর, স্ত্রী ও আশ্রিতদের না দিয়ে নিজেই ভালো ভালো খাবার খায় আমি যেন তাদের মত ভয়ানক গতি লাভ করি। যদি কাল আমি জয়দ্রথকে বধ করতে না পারি, তবে যে যে অধার্মিকের নাম বলা হল এবং যে যে অধার্মিকের নাম বলা হল না, আমি যেন তাদের সবার মত গতি পাই। “আমি আরো প্রতিজ্ঞা করছি যে কাল যদি জয়দ্রথ বেঁচে থাকতে থাকতে সূর্য অস্ত যায়, তাহলে আমি সেখানেই জ্বলন্ত আগুনে নিজের প্রাণত্যাগ করব। দেবতা, দানব, মানুষ, পাখি, সাপ, রাক্ষস, ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি এবং স্থাবর ও জঙ্গমের অন্যান্য প্রাণীরা কেউ আমার শত্রুকে রক্ষা করতে পারবে না। অভিমন্যুর হত্যাকারী পৃথিবী, আকাশ, স্বর্গলোক, দানবলোক বা রসাতল—যেখানেই থাকুক না কেন, আমার বাণ তার মাথা কেটে টুকরো টুকরো করে দেবে।”
এই কথা বলে অর্জুন গাণ্ডিব তুলে নিয়ে ভয়ঙ্কর শব্দে টঙ্কার দিলেন। সেইসঙ্গে কৃষ্ণ ও পান্ডবরা সবাই নিজের নিজের মহাশঙ্খে ফুঁ দিলেন। সেই ভীষণ শব্দে পৃথিবী কেঁপে উঠল। গুপ্তচরের মুখে এইসব কথা শুনে জয়দ্রথও ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। পরের দিনের যুদ্ধে কৌরবরা সবাই জয়দ্রথকে রক্ষা করতে সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের চেষ্টা কার্যকর হয়নি। কৌরবপক্ষের সমস্ত যোদ্ধাকে যুদ্ধে হারিয়ে সন্ধ্যার আগেই জয়দ্রথকে বধ করেছিলেন অর্জুন। প্রতিশোধ নিয়েছিলেন নিজের প্ৰিয় সন্তানের হত্যার।
তথ্যসূত্র
- ‘মহাভারত’,কালীপ্রসন্ন সিংহ, দ্রোণপর্ব, অধ্যায় ৭৩-৭৫, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৮
- ‘ছেলেদের মহাভারত', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, তৃতীয় মুদ্রণ, দ্রোণপর্ব, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৯