পশ্চিমবঙ্গের অর্ন্তগত হুগলী জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল উত্তরপাড়া (Uttarpara)। এই প্রাচীন জনপদটি হুগলী জেলার একেবারে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। উত্তরপাড়া জনপদটি শ্রীরামপুর মহকুমা ও কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ওরফে কেএমডিএ-র অর্ন্তভুক্ত। ১৮৫৩ সালে গড়ে ওঠা বাংলার প্রাচীন কোতরং পৌরসভার মধ্যে উত্তরপাড়া জনপদটি অবস্থিত।
উত্তরপাড়া জনপদটি ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ২২°৪০` উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮°২১` পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। শুরুতে উত্তরপাড়ার সঙ্গে হাওড়া ও বালির যোগাযোগ না থাকলেও পরবর্তীকালে ১৮৪৬ সালে বালি খালের উপর সেতু স্থাপন করে উত্তরপাড়ার সঙ্গে বালি যুক্ত হয়। ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে উত্তরপাড়ার উত্তরে ভদ্রকালী, দক্ষিণে বালি, পশ্চিমে রেললাইন, পূর্বদিক বরাবর প্রবাহিত হয়েছে হুগলী নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই হুগলী নদীর তীরেই রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। এই উত্তরপাড়ার বর্তমান পরিধি ১১.৭৫ বর্গ কিলোমিটার।
এই জনপদটির নামকরণের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। উত্তরপাড়া অঞ্চলটি পার্শ্ববর্তী বালির উত্তরে অংশে অবস্থিত হওয়ার কারণে একসময় এই অঞ্চলটি উত্তর বালি নামেই পরিচিত ছিল। পরে সেই থেকেই উত্তরপাড়া নাম প্রচলিত হয়।
উত্তরপাড়ায় প্রাচীনকালের ইতিহাসের ছাপ অতি স্পষ্ট। ১৬৯০ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি জব চার্ণক কলকাতায় বাণিজ্য কুঠী স্থাপন করেন। সেখানে বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পিতৃপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর নাতি রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী বাস করতেন। সেই অঞ্চলে ইংরেজদের আমোদ-প্রমোদে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি পরিবার নিয়ে উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধান করতে লাগলেন। তাঁর পরিচিত শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়ের কাছ থেকে বালির উত্তর অংশের জমি কিনে তিনিই উত্তরপাড়া শহরের পত্তন করেন। বর্তমানে উত্তরপাড়ায় রামহরি রায় লেনের রত্নেশ্বর রায়চৌধুরীর অট্টালিকার পশ্চিমাংশের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। উত্তরপাড়ার প্রথম বাসিন্দা আদপে ছিলেন রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী। সেই সময় তাঁর বানানো অট্টালিকাটি সাবর্ণ হাভেলি নামে পরিচিত ছিল যার পরে নাম হয় সাবর্ণ ভিলা। শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতে উত্তরপাড়াকে যিনি বিখ্যাত করে তুলেছিলেন, তাঁর নাম জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন রত্নেশ্বরেরই জামাতা। উত্তরপাড়ার রায়চৌধুরী পরিবারের কন্যার সঙ্গে হুগলীর খামারগাছির রামনিধি চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়েছিল। এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের জামাই হলেন নন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় যিনি উত্তরপাড়ায় জমিদারি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাতি জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর ছাত্র ছিলেন। কোতরং পৌরসভা ও জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি তাঁরই তৈরি। কোতরং পৌরসভার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় হুগলী জেলার প্রথম পৌরসভা এটি। হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও এখানে এসেছিলেন বহুবার। হুগলী জেলায় প্রথম উত্তরপাড়াতে ১৮৫৯ সালে দশ হাজার বর্গ কিমি. ও তিন একর এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি। গঙ্গার ধারে গড়ে ওঠা এই গ্রন্থাগারের জন্য একক প্রয়াসে ১২ হাজার বই সংগ্রহ করেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। এই লাইব্রেরিতে বহু বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সমাগম ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী ওঙ্কারানন্দ সরস্বতী, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাকি তাঁর শেষজীবনে প্রায়ই এই জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে আসতেন। উত্তরপাড়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী অবদান রেখেছেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ ভাই। স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারে এক টাকা ও দুই টাকা মূল্যের মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন তাঁর ভাই বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ ও বি. এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি একইদিনে সি. এস.আই এবং রাজা উপাধি লাভ করেন। তাঁর নামানুসারে উত্তরপাড়া কলেজের নাম রাখা হয় রাজা প্যারীমোহন কলেজ। উত্তরপাড়াকে ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে দিয়েছেন মনমোহন মুখোপাধ্যায়। তিনি ১৯১১ সালে মোহনবাগান দলের হয়ে খেলে ইংরেজ দলকে হারিয়ে অন্যতম ফুটবলারের স্বীকৃতি পান। এই অঞ্চলে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে ঋষি অরবিন্দ ঘোষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় এই জনপদকে ‘ওতোরপাড়া’ বলেই ডাকতেন স্থানীয় মানুষজন। ১৮৫৩ সালে উত্তরপাড়া পৌরসভা গড়ে ওঠে, ঐ বছরই ১৪ এপ্রিল পৌরসভার সদস্যদের একটি সভা আয়োজিত হয় এবং পৌরসভা স্থাপনের পরে তাঁরা কাজে নিযুক্ত হন। এলাকার শান্তি বজায় রাখতে এখানে চারজন চৌকিদার এবং সাতজন পাইককে নিয়োগ করা হয়। ১৮৭৫ সালে উত্তরপাড়ায় পুলিশের আউটপোস্ট তৈরি হয়। ১৯১৬ সালে এই আউটপোস্ট থেকেই পূর্ণমাত্রার থানা গড়ে ওঠে। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত উত্তরপাড়া পৌরসভা থেকেই পুলিশি নিরাপত্তার খরচ দেওয়া হত।
উত্তরপাড়ার পোদ্দারঘাট আজ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকলেও সেখানে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু একসময় শ্রমজীবী মানুষদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৯৩৮ সালের ১৬ জুলাই এই পোদ্দারঘাটে নেতাজী ভাষণ দিয়েছিলেন। শেওড়াফুলির সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের বাড়িতে সেদিন তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
উত্তরপাড়ার বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রথমেই স্মর্তব্য জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের নাম। তাছাড়া এই জনপদেরই সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের সমীর রায়চৌধুরী এবং মলয় রায়চৌধুরী পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ভারতের প্রথম পেশাদার চিত্রগ্রাহক লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীও এই উত্তরপাড়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশের সন্তান ছিলেন। এছাড়া এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের বিচারপতি প্রমদাচরণ ব্যানার্জী, সেতারবাদক মণিলাল নাগ, ফুটবলার প্রীতম কোটাল, সঙ্গীতশিল্পী এবং বর্তমানে রাজনীতিবিদ বাবুল সুপ্রিয়র জন্মও এই উত্তরপাড়াতেই।
উত্তরপাড়া জনপদটিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে দুটি কলেজ যথা রাজা প্যারীমোহন কলেজ ও স্বামী নিসম্বলানন্দ বালিকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চারটি বিদ্যালয় রয়েছে উত্তরপাড়ায়। যেমন উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরপাড়া অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, ভদ্রকালী উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি।
উত্তরপাড়ায় শিল্পের বিকাশ হয়েছে। এখানে অ্যাম্বাসাডার ও ট্রেনের ওয়াগন তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে অ্যাম্বাসাডারের কারখানাটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কলকাতা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরপাড়া জনপদটির উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, কলেজ ঘাট, পঞ্চরত্ন শিবমন্দির, জমিদার বাড়ি। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিগুলির মধ্যে একটি। জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে আজও বহু দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি শ্রীমতি প্রতিভা পাতিল এই লাইব্রেরির দেড়শো বছর পূর্তি উদ্যাপনে উপস্থিত ছিলেন এবং এই লাইব্রেরির বইগুলি সংরক্ষণের জন্য ১০ লক্ষ টাকা অনুদান বরাদ্দ করেন।
উত্তরপাড়াকে ক্ষুদ্র গ্রাম থেকে বৃহৎ শহরে পরিণত করার পেছনে মুখোপাধ্যায় পরিবারের অবদান অনেক। বহু মনীষীর চরণ স্পর্শে ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্মস্থানে ভূমিটি আজ অগ্রগতির পথে চলমান। তাদের স্মরণার্থে উত্তরপাড়ায় বিভিন্ন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে যথা নেতাজি সুভাষ রোড, রাজা প্যারীমোহন রোড,অমরেন্দ্র সরণী ইত্যাদি। আজও উত্তরপাড়ার প্রতিটি অংশে প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধ বিদ্যমান।
তথ্যসূত্র
-
'উত্তর সাক্ষর', জয়কৃষ্ণ সাধারণ গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতি, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা ৮৩, ৮৪, ১২৫, ১২৮, ২১৪, ২৩৪, ২৪৩-৪৪, ৩৫৫ -৩৫৮, ৩৬২- ৩৬৩, ৪০৫
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.anandabazar.com/
- http://ganashakti.com/