প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে একটি হল জাতীয় শহীদ দিবস (Martyr’s Day)।
প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি সমগ্র ভারত জুড়ে জাতীয় শহীদ দিবস পালিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুদিনকে স্মরণে রেখে গান্ধীজি সহ ভারতের অন্যান্য বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। আজকের স্বাধীন ভারতের জন্য, দেশের সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য লড়াই ব্রিটিশদের শৃঙ্খল ছিন্ন করার জন্য লড়াই করেছিলেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ৩০ জানুয়ারি সেই সব শহীদদের স্মরণ করার দিন।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নয়া দিল্লির বিড়লা হাউসে এক সমাবেশে হিন্দু মহাসভার সদস্য এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রাক্তন সদস্য নাথুরাম গডসে গুলি করে হত্যা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীকে। সকাল থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন গান্ধী। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সহ আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সেরে বিকেল পাঁচটার সময় তিনি যখন বিড়লা হাউজের পিছনদিকের লনে একটি ধর্মীয় প্রার্থনা সভায় যোগ দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন সেই সময়ই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে নাথুরাম গডসে গান্ধীজির পেটে এবং বুকে মোট তিনটি গুলি করেন। গান্ধীজির দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঐ বছরই দিল্লির লালকেল্লায় নাথুরাম গডসে এবং তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তের বিচারে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৭৮ বছর বয়সে ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজি নিহত হন। গান্ধীজির এই মৃত্যুদিনকে স্মরণ করতেই সমগ্র ভারত জুড়ে জাতীয় শহীদ দিবস পালন করা হয়।
ভারতের অন্যতম মহান নেতা ছিলেন গান্ধীজি। অহিংসার আদর্শে সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তিনি। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর পুরো নাম ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৩ বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার যুদ্ধেও নেলসন ম্যাণ্ডেলাকে সাহায্য করতে আফ্রিকায় পাড়ি দেন তিনি এবং ১৯১৫ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখলের অনুরোধে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসেন। অহিংসার মতাদর্শ প্রচারের জন্যই মূলত তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ভারতের সার্বিক পরিসরে তাঁর অবদানকে স্মরণ করে তাঁকে ‘জাতির জনক’ আখ্যা দেওয়া হয়। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে গান্ধীজি পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তাৎপর্য আজও স্মরণীয়। ১৯৩০ সালের বিখ্যাত ডাণ্ডি অভিযান আজও ইতিহাসে পরিচিত। ভারতবাসীরা তাঁকে ভালোবেসে ‘বাপুজি’ বলে ডাকতো। তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী নাথুরাম গডসে মনে করতেন দেশভাগের সময় গান্ধীজি ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়কে প্রয়োজনের অধিক সাহায্য করেছিলেন এবং তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হিন্দুদের অবহেলা করেছেন। তাই গান্ধীজিকে হত্যা করেন নাথুরাম। গান্ধীজির মৃত্যুদিনকে স্মরণ করতে এবং একইসঙ্গে ভারতের অন্যান্য বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণে সমগ্র ভারতে ৩০ জানুয়ারি দিনটিকে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি ছাড়াও ২৩ মার্চ, ১৯ মে, ২১ অক্টোবর, ১৭ নভেম্বর, ১৯ নভেম্বর এবং ২৪ নভেম্বর দিনগুলিও শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ভগত সিং, রাজগুরু এবং শুকদেবের মৃত্যুর স্মৃতিতে ২৩ মার্চ পালিত হয় শহীদ দিবস। তাছাড়া আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৫ জন বাঙালি আর তাঁদের স্মরণে শহীদ দিবস পালিত হয় ১৯ মে। এমন অন্যান্য দিনগুলিরও শহীদ দিবস হিসেবে বিশেষ বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
প্রতি বছর ৩০ জানুয়ারি ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একত্রে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে একত্রিত হন এবং জাতির জনকের মর্মর মূর্তিতে মাল্যদান করেন। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এবং আন্তঃবাহিনীর কন্টিনজেন্ট কর্মীরা সকলেই এই দিনে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানান, একইসঙ্গে ভারতের অন্যান্য মহান বিপ্লবীদেরও স্মরণ করেন তাঁরা। সাধারণ মানুষেরাও সেই প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে দু মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে গান্ধীজিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে বেশ কিছু ভজন এবং আধ্যাত্মিক সঙ্গীত গাওয়া হয় গান্ধীজির স্মরণে। বহু স্কুলেও এই দিন পালিত হয় যেখানে দেশাত্মবোধক গান ও নাটকের মাধ্যমে স্কুল-শিক্ষার্থীরা জাতীয় শহীদ দিবস পালন করে থাকে।
2 comments